আমি সব সময় হাসতে পারি, এমনকি জাহান্নামেও হাসতে পারি : বঙ্গবন্ধু

আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৪, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:১৭ মার্চ, ১৯৭১ : এদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া-মুজিব এক ঘণ্টা স্থায়ী আলোচনা হয়। সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন। তিনি কালো পতাকা সজ্জিত একটি সাদা টয়োটা গাড়ি ব্যবহার করেন। বঙ্গবন্ধুকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট ভবনের ফটকে অপেক্ষামান বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক তাকে ঘিরে ধরেন। ‘আলোচনা শেষ হয়নি এবং আরো চলবে’- এর বেশি তিনি সাংবাদিকদের বলেননি।

সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে গিয়ে ধর্ণা দেন। সে সময় ঢাকার দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা প্রতিদিন একাধিকবার তাঁর বাসভবনে যেতেন। কারণ সে সময় কয়েকটি সেনানিবাস ব্যতিত গোটা পূর্ব বাংলা তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছিল।

বাসভবনে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে- এর লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন- ‘আমি কি আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি?’ বঙ্গবন্ধু অপর এক প্রশ্নে জবাবে বলেন, তাঁরা উভয়েই কারো সাহায্য ছাড়াই এক ঘণ্টা আলোচনা করেছেন।

সাংবাদিকদের সাথে ঘরোয়া আলোচনার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। জনৈক বিদেশি সাংবাদিক তখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, আপনার এ হাসি থেকে কি আমরা কিছু ধরে নিতে পারি? তিনি সহাস্যে জবাব দেন ‘আমি সব সময় হাসতে পারি এবং এমনকি জাহান্নামেও হাসতে পারি।’ বিদেশি সাংবাবিদকরা এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৫২তম জন্ম দিনে শুভেচ্ছা জানালে তিনি বলেন, ‘১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আমার জন্ম। আমি কখনও আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতেও পারে না মরার কথা, তখনও তারা মরে। যখন কেউ ইচ্ছা করে না তখনও তাদের মরতে হয়।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার জন্ম দিনই কী মৃত্যু দিনই বা কী? আমার জীবনই বা কী? মৃত্যু ও জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।’

অন্য এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “সাত কোটি মানুষ যখন পাহাড়ের মত আমার ও আমার দলের পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন আমার চেয়ে সুখি মানুষ আর কে হতে পারে।
পরিস্থিতি সম্পর্কে বিদেশি মিশনগুলোর সাথে যোগাযোগ করেছেন কী-না প্রশ্ন করা হলে বঙ্গবন্ধু নেতিবাচক উত্তর দেন এবং বলেন যে, ‘তারা এখানেই আছেন এবং সমস্ত ঘটনা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছেন।’

আজ সেনাবাহিনীর জন্য রসদ নিয়ে করাচি থেকে একটি সি-১৩০ পরিবহণ বিমান ঢাকা আসে। বিমানে জবাই করা খাসি ও মুরগির মাংস ছিল।
তেজগাঁ বিমান বন্দর সে সময় বাঙালিদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা হলেও ঢাকার সাংবাদিকরা সেনানিবাসের বা সংশ্লিষ্ট খবরাদি কীভাবে পেত এ সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে বক্তব্য হচ্ছে: বিমান ও স্থল বাহিনীর কিছু সংখ্যক অফিসার ও সৈন্য ছদ্মবেশে বঙ্গবন্ধুর বাসবভনে আসতেন। তারা সেনানিবাসের অবস্থা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য খবরাদি বিশ্বস্ত বাঙালি সাংবাদিকদের দিতেন। এবং বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করানোর অনুরোধ করতেন। বাঙালি জাতির ওপর কেয়ামতের মত বিপদ নেমে আসতে পারে এ জাতীয় খবরের আভাস ছদ্মবেশী বাঙালি সৈন্যরা প্রদান করেছেন। একদিন বঙ্গবন্ধু ভবনে ছদ্মবেশে মেজর খালেদ মোশাররফকেও দেখা দেছে। সাংবাদিকরা এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন। জবাবে তিনি বলতেন, ‘আমি সব জানি সব খবর পাচ্ছি। নিরস্ত্র লাঠিধারী বাঙালি ইপিআরদের তো তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে পাহারা দিতে দেখেছেন।’

সন্ধ্যার পর ঢুকতে একটি পাস ওয়ার্ড বা সাংকেতিক শব্দ সেনা প্রাহরীদের বলতে হয় যে এই সাংকেতিক শব্দ বলতে না পারলে রাতের মত প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। একজন বাঙালি সেনা অফিসার সাংবাদিকদের জানান ১৭ মার্চের সাংকেতিক শব্দ হচ্ছে ‘শাহী ওয়াল’।

এদিন বিকেলে চট্টগ্রামের উত্তর হলিশহরে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘বাংলাদেশে সকল কলকারখানার মালিক হচ্ছে ৭ কোটি বাঙালি। সুতরাং নিজস্ব এই কলকারখানা কারো পক্ষেই বিনষ্ট করা উচিত হবে না।’
তিনি ঘোষণা করেন, ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে আপোষের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।

স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর এবং শেখ মুজিবের সাথে পরিষ্কার কোনো বোঝাপড়া হয়েছে কিনা, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে মওলনা ভাসানী বলেন, ‘সব কিছুই সাংবাদিকদের কাছে বলা যায় না। অনেক কিছুই রাজনীতিকদের নিজের কাছে গোপন থাকে।’

ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব বাংলা এখন কার্যতঃ একটি স্বাধীন দেশ। এখানে সামরিক সরকারের কোনো নির্দেশ আর কার্যকরি হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নির্দেশই জনগণ মেনে নিচ্ছে এবং স্টেট ব্যাংক থেকে শুরু করে শুল্ক আদায় পর্যন্ত সকল সরকারি বেসরকারি কাজকর্ম আওয়ামী লীগের নির্দেশেই চলছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আসম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালনের জন্য স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানান। ওই দিন কালো পতাকার পাশে বাংলাদেশ নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুরোধ জানান হয়।