ফোকলোর বিশারদ মযহারুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস আজ

আপডেট: নভেম্বর ১৫, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ


নিজস্ব প্রতিবেদক:


কবি, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, গবেষক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফোকলোর বিশারদ, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রফেসর মযহারুল ইসলামের ২০ তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ নভেম্বর বাদ মাগরিব প্রফেসর মযহারুল ইসলামকে শাহজাদপুরে তার ‘নূরজাহান’ নামের নিজ বাস-ভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।

ড. মযহারুল ইসলাম সিরাজগঞ্জ জেলার চরনবীপুর গ্রামে ১৯২৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. মোহাম্মদ আলী। মযহারুল ইসলাম মেট্রিক পাশ করেন তালগাছী আবু ইসহাক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে কৃতিত্বের সাথে আই.এ. পাশ করেন সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে। এরপর রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে বাংলা বিষয়ে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত বাংলা এম.এ. প্রিভিয়াস পরীক্ষায় এবং ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত এম.এ. ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একই সাথে তিনি গোল্ড মেডেলিস্ট এবং কালীনারায়ণ স্কলারের গৌরব অর্জন করেন।

১৯৫২ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে মেধার ভিত্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের গোড়ার দিকে মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র তত্ত্বাবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৬৩ সালে মযহারুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ডিগ্রি অর্জনের পর এক বছর তিনি আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৪ সালে দেশে ফিরে এসে বাংলা বিভাগের প্রফেসর এবং বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে প্রফেসর ইসলাম কলা অনুষদের ডিন নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর পদে আমন্ত্রিত হন।

হার্ভার্ডের মেয়াদ শেষ হবার পর তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি এ্যাট বার্কলীতে কিছুদিন ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রফেসর মযহারুল ইসলামকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনা এবং সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশপাশি দেশে-বিদেশে অসংখ্য সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের সাথে মযহারুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সুনির্দিষ্ট নির্দেশ নিয়ে তাঁরা রাত ১০টার দিকে ৩২ নম্বর বাসা থেকে বের হয়ে আসেন। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার সাথে সাথে দেশে শুরু হয়ে যায় ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ড. মযহারুল ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।

প্রফেসর মযহারুল ইসলাম একই সাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কলম দিয়ে এবং অস্ত্র হাতে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর কালবিলম্ব না করে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে যাদেরকে কোলকাতা থেকে ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়েছে, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ছিলো তাদের একজন।

১৯৭২ সালের ১০জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে ড. মযহারুল ইসলামকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দান করেন। তিনি ২২শে মার্চ ১৯৭২ থেকে ১৮ অগস্ট ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

ড. মযহারুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের উপাচার্য পদে নিয়োগদান করেন। ১৯৭৪ সালের ১৯ আগস্ট তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার-পরিজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর মাত্র এক মাসের মাথায় ১৯ সেপ্টেম্বর মযহারুল ইসলামকে উপাচার্য পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বিবেচনায় রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ তিন বছর তাঁকে কারারুদ্ধ রাখা হয়।

কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসে তিনি তাঁর স্থায়ী পদ বাংলা বিভাগের প্রফেসর পদে যোগদানপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বাংলা বিভাগে তাঁর নিজ পদে যোগদান করতে দেয়া হয় নি। এই পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ভারতীয় ইউজিসির আমন্ত্রণে তিনি চলে যান ভারতে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, রাচী বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ছয় বছর শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন।

মযহারুল ইসলাম যখন সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। মযহারুল ইসলামের কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা দশের অধিক। উল্লেখযোগ কাব্যগ্রন্থ- মাটির ফসল, যেখানে বাঘের থাবা, আর্তনাদে বিবর্ণ, কাব্য বিচিত্রা ইত্যাদি। প্রবন্ধ, গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ২৫ এর অধিক।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ফোকলোর পরিচিতি ও পঠন-পাঠন, লোকাহিনী সংগ্রহের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ফোকলোর চর্চায় রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি, ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, রবীন্দ্রনাথ : কবি, সাহিত্যশিল্পী এবং কর্মযোগী, বিচিত্র দৃষ্টিতে ফোকলোর, বাংলা ভাষা-বাঙালি সংস্কৃতি ইত্যাদি। অনুবাদ গ্রন্থ- বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, ছোটগল্প- তালতমাল, উপন্যাস- এতটুকু ছোয়া লাগে।

তিনি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন চারটি যেমন- ফোকলোর, মেঘবাহন, সাহিত্যিকী, উত্তর-অন্বেষা। বাংলাদেশ ফোকলোর সোসাইটির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জাতীয় কবিতা পরিষদ, জাতীয় চারনেতা পরিষদে আজীবন তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৬৮ সালে তাঁকে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৭০ সালে তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তানের উচ্চতম সাহিত্য পুরস্কার ‘দাউদ পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। শিল্প-সাহিত্যের জগৎ ছাড়াও শিক্ষা, জনসেবা এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান তিনি রেখে গেছেন। তাঁর নিজ এলাকা শাহজাদপুরে ব্যক্তিগত অর্থে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন।

তথ্যসূত্র: ‘প্রফেসর মযহারুল ইসলাম : শ্রদ্ধাঞ্জলি’- প্রফেসর আবদুল খালেক, সাবেক উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।