বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ও বর্তমান বাঙালি নারী

আপডেট: ডিসেম্বর ৯, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

আখতার বানু বীণা

আজ ৯ ডিসেম্বর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রতিবছরই এই দিনটি ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে পালিত একটি জাতীয় দিবস। মহিয়সী বেগম রোকেয়ার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে নারী জাগরণে, ‘বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ও বর্তমান বাঙালি নারীদের অবস্থান এ সম্পর্কে কিছু কথা-
আমরা জানি, প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি মেয়েরা রক্ষণশীলতার নামে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় বাড়ির বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভের সূযোগ ছিল না। পুরুষ শাসিত সমাজে নারী ছিল ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গৃহকোণে অবরুদ্ধ। শত শত বছর ধরে বাঙালি নারীরা এ অবস্থায় থাকার কারণে তারা জানতেও পারেনি যে, তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত অধিকার বলতে কিছু আছে? কখনও উপলব্ধিতে এলেও তা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। শিক্ষা ও জ্ঞানলাভ বলতে যতটুকু উদারতা ছিল তা শুধু ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ায় নারী পুরুষের মুখাপেক্ষী ও ঘরবন্দি জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কোনো ভাবনায়ও আসেনি যে নারীরা সমাজ, দেশ, জাতির উন্নয়নে অবিচ্ছেদ্য অংশ, শিক্ষা এবং জ্ঞানলাভের পাশাপাশি নারীদেরও সমান অধিকার, মানসিক মুক্তি, স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে।

নারীকূলের এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের অবসানের আলোকবর্তিকা হয়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বেগম রোকেয়া। বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদুত হিসোবে যাঁর নামটি প্রথমেই উচ্চারণ করতে হয় তিঁনিই হলেন বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। জন্মের পর থেকেই সামাজিক এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা। এই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিঁনি নিজের লেখাপড়াকে এগিয়ে নেন। ৫ বছর বয়সে মা’র সাথে কলকাতায় বসবাসের সময় মেম শিক্ষকের নিকট কিছুদিন লেখাপড়া করেন।

পরে সমাজ ও আত্মীয় স্বজনের সমালোচনায় তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু রোকেয়া থেমে থাকেননি। বড় ভাই বোনদের সাহায্য নিয়ে বাংলা, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু ভাষা আয়ত্ত করেন।

১৮৯৬ সালে বেগম রোখেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী ডেপুটি ম্যজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন সমাজ সচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন।

স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকে তাঁর সাহিত্য চর্চা। সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে। কলকাতা থেকে ‘নভপ্রভা’ পত্রিকায় ছাপা হয় গল্প ‘পিপাসা’
১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় মতিচুর। যেখানে তিনি নারী পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করে নারীকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
১৯০৮ সালে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ Sultana’s Dream” – “সুলতানার স্বপ্ন” প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে বেগম রোকেয়া নারীবাদী স্বপ্নরাজ্যের মাধ্যমে নারীকে উপস্থাপন করেছেন অর্থনৈতিক কাজের প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে আর পুরুষ সমাজকে রেখেছেন ঘরে অবরুদ্ধ করে।
১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় “অবরোধবাসিনী।” এখানে অবরোধ প্রথাকে প্রচণ্ড ব্যঙ্গ সহকারে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি শব্দে নারীর বেদনার ক্রন্দন ও অশ্রুজল স্তম্ভিত হয়ে আছে। অসহনীয় অবরোধ প্রথার করেণে নীরবে দ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন তিঁনি।
বেগম রোকেয়ার স্মরণীয় উক্তি-
“আমরা উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কী হাত নাই, পা নাই, না বুদ্ধি নাই, কী নাই” যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকোণে ব্যয় করি, সে পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?”
এসব লেখনির মধ্যে স্পষ্ট প্রকাশ- পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমমর্যাদা ও অধিকারের কথাই তুলে ধরেছেন। তদানিন্তন সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লেখালেখির মধ্যদিয়ে নারীর অধিকারের কথা বলেছেন। মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং শাণিত লেখনির মধ্য দিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ শতকের এক বিরল ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন। উপমহাদেশের নারীমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টার অন্যতম জন।

নারীমুক্তির জন্য যে স্বপ্ন তিঁনি দেখেছিলেন আজ তার স্বপ্ন অনেকাংশই পূরণ হয়েছে। শাশন, শোষণ বঞ্চনার শিকার হওয়া স্বত্ত্বেও নারী আজ স্বাবলম্বী। বর্তমানে বাঙালি নারীদের অভাবনীয় অগ্রগতি।

বেগম রোকেয়া থেকে সুফিয়া কামাল পর্যন্ত যে সময় অতিবাহিত হয়েছে, সেখানে বাংলার নারীর স্বীয় মর্যাদা, অধিকার অদায়ের কথা যা নারীমুক্তি আন্দোলনে উদাহরন ও অনুপ্রেরণার।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী পুরুষের পাশাপাশি থেকে দেশ রক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। বর্তমানে নারী পুরুষের সাথে বুদ্ধির খেলায় মেতেছে। বীরঙ্গণা বেশে যুদ্ধ করছে। দুঃসাহসিক অভিযানে পাল্লা দিচ্ছে, দেশসহ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন, দুই দলের প্রধান দুই নেত্রী। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া। দশম জাতীয় নির্বাচনের পর বিরোধী দলীয় নেত্রী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। আমাদের জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী। দেশের কতকগুলো মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন কয়েকজন নারী নেতৃত্ব। তার প্রধান ভূমিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আছেন দীপু মনি, ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা এমপি।
শুধু দেশেই না আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয় অবস্থান করে নিয়েছেন অনেকেই।

মাননীয স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসাসিয়েশনের নির্বাচনে নির্বাচিত চেয়ার পার্সন নির্বাচিত হন।
অটিজম বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খেকে ‘ হু এক্সিলেন্স’ পদকে ভূষিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের হেলডন সিটির নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হন তাহসিনা আহমেদ। যাঁর বাড়ি সিলেটের গোপালগঞ্জে। লন্ডনে চারজন বাঙালি নারী পার্লামেন্ট সদস্য -বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী, রূপা হক এবং.আফসানা বেগম। রূপা হক শুধু এমপিই নন, তিনি লন্ডনে কিংস্টন ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক। এছাড়াও লন্ডনের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন।

বিশ্বে কূটনৈতিক হিসাবে ইসমাত জাহান ইউরোপীয় পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন। ইসমত জাহান শুধু নিজেই নন, তাঁর মা প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্টের এমপি ছিলেন।

ভাস্কর শিল্পে শামীম শিকদার, যিনি ঢাকা বিম্ববিদ্যালয় এলাকায় দুটি শিল্পকর্ম স্থাপন করেন- বঙ্গবন্ধু ফোয়ারায় স্বাধীনতার সংগ্রাম ও টিএসসি চত্বরে স্বাধীনতা নামক শিল্পকর্ম। দেশের বাইরে কমপক্ষে ২০ টি দেশে শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠা করে সম্মান বয়ে এনেছেন।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন কর্নেল ডা. নাজমা বেগম। নারী পুলিশ কর্মকর্তা মিলি বিশ্বাস এর কথা আমাদের সকলেরই জানা।
খেলাধুলায এশিয়া গেমসে সোনার পদক এনে দিয়েছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। রোপ্য পদক এনে দিয়েছেন ফুলপতি চাকমা এবং রূপা আক্তারসহ অনেকেই। পর্বতারোহী বাঙালি নারী নিশাত মযুমদার ও পরে ওয়াশফিয়া নাজরীন এভারেস্ট জয় করেছেন। সারাবিশ্বে – বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, জাপান, জার্মানিসহ দেশের সংবাদ সংস্থাগুলোতে খবর পড়েন আমাদের মেয়েরা। অভিনয়ে অবদান রেখেছেন সুচিত্রা সেন, ড. ববিতা। গানের ক্ষেত্রে- রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন আরও অনেকে।
ছোট্ট আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে- বর্তমানে নারী শুধু পুরুষের নম্র সহচরী নয় বরং সারাবিশ্বে তাঁদের অবস্থান দৃঢ় করেছেন।