মহান বিজয় দিবস

আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ

আব্দুল হামিদ খান

‘এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত
সেই রক্তাক্ত সময়…’
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় এমনই প্রশ্ন জাগে। বিশেষ করে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে করোনাকালেও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বিজয়ের নানা অনুষ্ঠানে এমন প্রশ্ন মনের অজান্তেই হৃদয়কে তাড়িত করে। স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটে। আজ সেই দিন। ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়। জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এই বিজয়ের মাসে প্রথমেই সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি স্বাধীনতার প্রবাদ পুরুষ, মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। যার কালজয়ী নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়।

সেই সাথে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি অকুতোভয় দেশপ্রেমিক শহিদ বুদ্ধিজীবীদের, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা অকাতরে দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা যুগিয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি রইল বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

স্বাধীন বাংলাদেশের অবির্ভাব ছিল যুগান্তকারী এক ঘটনা। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস, পূর্ব বাংলার মানুষের চরম বঞ্চনার ইতিহাস, পদে পদে লাঞ্চনার ইতিহাস;’ চরম বৈষম্য, অপমান আর অবজ্ঞার ইতিহাস। এ ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার চরম বর্ণবাদী ইতিহাসের কথা।

শাসক শ্রেণি বন্দুকের নল আর শক্তি দিয়ে দুঃশাসন চালিয়ে যাচ্ছিল। ভাষার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে বাংলার মানুষকে উর্দূভাষা রাষ্ট্রভাষা বলে মুখে পুরে দিচ্ছিল। কিন্তু না ! বাঙালি গর্জে উঠল। মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রতিবাদ জানালো রাজপথে।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১। দীর্ঘ ১৯ বছরে বৈষম্য আর শোষণের পরিধি বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে জনগণের পর্বতপ্রমাণ রায়কে পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা শাসক তাচ্ছিল্যভরে পায়ে ঠেলে দেয়। বাংলার মানুষ, গোটা বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহায় হয় ঐক্যবদ্ধ। হাতে হাতিয়ার তুলে নেয়, অবতীর্ণ হয় সশস্ত্র সংগ্রামে। ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকেই কার্যত দেশের শাসন কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে আসে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ সর্বত্র শিথিল হয়ে যায়।

এদিকে ইয়াহিয়া-ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক প্রহসনমূলক আলোচনায় মিলিত হয় ঢাকায়। একদিকে আলোচনা চলে, অন্যদিকে পূর্ব বাংলায় গোপনে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি বাড়তে থাকে। অবশেষে ২৪ মার্চ ঢাকায় আগত পশ্চিম পাকিস্তানের সব নেতা পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় অতি গোপনে ইয়াহিয়া খান করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। আর ওই কালরাতেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কামান ও মেশিনগান নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অবশেষে জেনারেল নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতির বিজয় সূচিত হয় এবং বিশ্ব মানচিত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশর অভ্যুদ্বয় ঘটে।

পৃথিবীর মানচিত্রে যে কয়টি দেশ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। আমাদের স্বাধীনতা এসেছে রক্তক্ষয়ী পথপরিক্রমা ও ইতিহাসের সংগ্রামী অধ্যায় পেরিয়ে এক গৌরবোজ্জ্বল বিজয়গাঁথা নিয়ে। ৫৩ বছরে আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু আমরা কি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছি? কেন পারিনি, এসব পর্যালোচনা করে এগোতে হবে সামনে।

মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর এগিয়েছে অনেক দূর। আমাদের কী নেই, যে কারণে আমরা পিছিয়ে আছি? স্বাধীনতা লাভের সময় পাটের ওপর যে ভরসা ছিল, তা হারিয়ে যেতে বসলেও এবছর কৃষকরা ভালো দাম পেয়ে আবার পাট নিয়ে আশাবাদী হতে শুরু করেছেন। বর্তমানে সরকার পরিচালিত চিনিকলগুলো আমাদের হতাশ করছে। মিল কর্তৃপক্ষ ও একটি দুষ্টচক্রের যোগসাজশে নানা কারসাজিতে হরিলুট হয় এখানে আর ভোগান্তি পোহাতে হয় দুর্র্ভাগা চাষীদের। বিভিন্ন সেক্টরে এভাবেই জাতীয় সম্পদ লোভী-দুর্নীতিবাজদের পকেটে যাচ্ছে।

এমন সব রাঘববোয়ালদের কর্মের ফসলেই আমরা হারিয়েছি এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল, গর্ব করার মত ইস্পাত কারখানা। রেলপথের দুর্গতি আমাদের বড়ই দুঃখ দেয়। অবশ্য স্বাধীন দেশে প্রাপ্তিও আছে। নতুন শিল্প গড়ে উঠেছে তৈরি পোশাকের। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো স্বপ্নের পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের উদ্বোধন। স্বপ্নের এসব মেগা প্রজেক্টের কারণেই অর্থনীতির চাকা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। সেই সাথে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরও জীবন বদলে যাবে, বদলে যাবে তাদের জীবন-জীবিকার চিত্র। অন্যদিকে রপ্তানি হচ্ছে মানুষের শ্রম। এ মানব সম্পদ আমাদের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করছে অবিরত।

এ বিজয়কে সামনে রেখেই নব উদ্যামে, নব প্রত্যয়ে, নব প্রত্যাশায় আমরা সকল বিভেদ ভুলে একসঙ্গে বিজয় দিবসে, অমূল্য এই দিনে আসুন দেশ গড়ার অঙ্গীকার করি, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ি।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট