শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, বিশ্ব খ্যাত হয়েছেন হেলেন কেলার

আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

আখতার বানু বীণা

আমাদের সকলেরই জানা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসম্পূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধী বলে অর্থাৎ যারা দৈহিক ও মানসিকভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন না। বিভিন্নভাবে মানুষ প্রতিবন্ধী হয়। কেউ কেউ জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। আবার এক ধরনের প্রতিবন্ধীর সৃষ্টি হয় নানা দূর্ঘটনা থেকে। অনেক প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি হয় দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে।

মহিয়সী হেলেন কেলার ঠিক তেমনিভাবে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়েছিলেন। তবে এই প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে হেলেন কেলার হয়েছেন বিশ্বখ্যাত মহিয়সী নারী।

হেলেন কেলারের জন্ম ১৮৮০ সালের ২৭ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায়। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬৮ সালে ১ জুন। বাবার নাম আর্থার কেলার, মায়ের নাম ক্যাথরিন অ্যাডামস কেলার। শিশুকাল থেকেই হেলেন কেলার বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। অর্থাৎ কথা বলতে, দেখতে ও কানে শুনতে পেতেন না। ১৯ মাস বয়সে হেলেন গুরুতর অসুস্থ হলে, বাবাÑমা তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। এতে হেলেন কেলারের জীবন রক্ষা পায় কিন্তু চিরদিনের মত কথাবলা, দেখা ও শোনার শক্তি হারিয়ে যায়। এ অবস্থায় বাবা মা বিভিন্ন জনের কাছে পরামর্শ নিতে থাকেন এবং চিকিৎসা করাতে থাকেন।

টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল সে সময় ওয়াশিংটনে বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁর কথা জেনে বাবাÑ মা তাঁকে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এর কাছে নিয়ে যান।

আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেন Ñ‘ হেলেন কোনোদিনই আর দেখতে ও শুনতে পাবে না। তবে তার বুদ্ধি তীক্ষ্ন। ঠিকমত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিলে তার জীবন সুন্দর হবে।’ একথা শুনে বাবাÑমায়ের হতাশা কমলো। শুরু হলো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। যখন হেলেন কেলারের বয়স ৮ বছর তখন অ্যানি সুলিভান নামক একজন গৃহশিক্ষক তাঁর লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন। স্যুলিভান নিজেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন।

আ্যানি সুলিভান প্রথমে আঙ্গুল দিয়ে হেলেনের হাতে চিহ্ন এঁকে এবং বর্ণমালা কার্ড দিয়ে বর্ণমালা শেখান। শুরু হলো ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা। ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে হেলেন কথা বলা শেখেন। ১৪ বছর বয়সে নিউইয়ার্কে ‘রাইট হুমাসন’ স্কুলে ভর্তি হন। ২০ বছর বয়সে রেডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন। আর ২৪ বছর বয়সে প্রতিবন্ধী হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ডিগ্রি অর্জনের পূর্বেই তাঁর আত্মজীবনি ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’ প্রকাশিত হয়। তিনি অনেক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের চেয়ে বেশি বই পড়েছেন। শুধু পড়েছেন তাই নয়, বই লিখেছেন। তাঁর রচিত বই ১১ টি । প্রধান বই স্টোরি অফ মাই লাইফ, লেট আস হ্যাভ ফেইথ, দি ওয়ার্লড আই লিভ ইন, ওপেন ডোর ইত্যাদি। এছাড়াও তিঁনি বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত, বিড়ম্বনাময় জীবনের বিষাদের ওপর একটি চলচিত্র নির্মাণ করেছেন।

যেখানে নিজের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করেছেন। তিঁনি স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি সংগীত উপভোগ করতেন। হেলেন কেলার দাবা ও তাস খেলতে পারতেন। নদীতে নৌকা চালাতে ও সাঁতার কাটতে পারতেন। তাঁর ঘোষণা ছিল Ñ‘এ্কজন দৃষ্টিমান মানুষের মত আমরাও পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করতে চাই।’ তিনি প্রতিবন্ধী ও নারী অধিকারের প্রতি সোচ্চার ছিলেন। হেলেন কেলার একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক, সমাজসেবী ও রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। নিজের কথা উপলব্ধি করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করেছেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও বিশিষ্ট জনদের সহযোগিতায় স্কুল ও সমিতি গড়ে তোলেন।

তাঁর কমদক্ষতা গুণে ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে তিঁনি ভূষিত হন। হেলেন কেলারের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য গঠিত হয়েছেÑ ‘আমেরিকান অ্যাসেসিয়েশন ফর দ্য ওভারসিজ ব্লাইন্ড।’ পরে নাম পরিবর্তন করে ‘হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল’ করা হয়েছে।
হেলেন কেলার প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারে পাল্টে দিয়েছেন। তিনি অন্ধ ও বধির হয়েও তাঁর অনুভূতি ও বোঝার ক্ষমতা দিয়ে জীবন চলার পথকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছেন। সাথে আমাদের ধারণাকে স্পষ্ট করেছেন এভাবেÑ যে প্রতিবন্ধীদের বিকাশলাভে, সঠিক পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণের একান্ত প্রয়োজন। যার মাধ্যমে তাদের মেধা, সৃজনশীলতা ও দক্ষতার উন্নয়ন সম্ভব।

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। তাদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপি এই দিনটি প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহযোগিতা, সহমর্মিতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দ্যেশেই এই দিনটির সূচনা হয়। চলুন, সকলেই এই দিনটিকে কেন্দ্র করে, প্রতিটি দিনই পরিবারের, সমাজের, দেশের, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে থেকে তাদের উন্নয়নে, কল্যাণে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মাদার বখ্শ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, রাজশাহী

 

 

 

১৬/১১/২০২৩
কর্মব্যস্ত নারীর নিজের দেখাশোনা
প্রিয় পাঠক, বিশাল পৃথিবীতে শতভাগ মানুষের প্রায় অর্ধেক নারী। আদিযুগ থেকে বর্তমান শিল্প সাহিত্য, সভ্যতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কম নয়। নারী প্রেনণার উৎস, শান্তির প্রতীক,গর্ভধারিনী, মাতৃভাষার আধার, সৌন্দর্য্যের প্রতীক। নারী কখনও কন্যা, কখনও বোন, কখনও বউ. কখনও মা। একটি সময় ছিল যখন নারীদের ভাগ্য পুরুষের উপর নির্ভরশীল ছিল, স্বতন্ত্র সত্ত্বা ছিল না। সুখের বিষয় নারী আজ নিজ গুনে অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন থেকে বেরিয়ে আলোকিত জগতের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে, সংসারে, গৃহস্তালি কাজে, বসতবাড়ির কাজে, অফিস আদালতসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করছে। নারী স্বাবলম্বী হয়েছে। তাই তাদের বেড়েছে দারুণভাবে কর্মব্যস্ততা। কারণ প্রাচীন প্রথা অনুসারে সংসারের দায়িত্ব পালনের পর, তারা অফিসÑ আদালতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। ফলে বেশিরভাগ নারীই শারীরিক ও মানসিক দিকের প্রতি নজর দিতে পারছেন না। নিজের প্রতি এই অবহেলা নিজেকে চরম দূর্ভোগের মধ্যে ফেলছে। প্রায় সময়ই আমরা অনুভব করি কাজের দক্ষতা ও সফলতা আনতে সুস্থ থাকা প্রয়োজন কিন্তু সামর্থ্যরে বাইরে কাজ করে আমরা হাঁপিয়ে উঠি Ñ অসুস্থ হয়ে পড়ি। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানান জটিল রোগে জড়িয়ে পড়ছি।
তাই সকল কাজের মধ্যে মনে রাখতে হবে Ñ মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ নিজ জীবন, শরীর ও সুস্থতা। এসবের জন্য নিজেকেই নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। যার জন্য প্রয়াজন নিয়মানুযায়ী খাওয়া দাওয়া করা, ঘুমানো, ঘুম থেকে উঠা,ব্যায়াম, রূপচর্চা করা, গোসল করা, মানসিক চাপ কমানো এবং বিণোদনের ব্যবস্থা থাকা। পারিবারিক কাজের চাপ কমানোর জন্য একজন কর্মব্যস্ত নারী যা করতে পারেন তা হলো-
ক্স ঘরের কাজে স্বামীর সাহায্য পাওয়া গেলে তা মনমত না হলেও বিরক্ত না হয়ে কাজটা শিখিয়ে দিন, প্রশংসা করুন তাহলে পরে সহযোগিতা পাবেন।
ক্স পড়ার টেবিল, বিছানা, ঘর গোছানোর দায়িত্ব সন্তানকে দিন।
ক্স পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিনের কাপড় চোপড় তুলে ভাজঁ করে যথা জায়গায় রাখতে শেখান।
ক্স প্রয়োজনীয় বিল কাগজপত্র হাতের নাগালে রাখুন, সহজে পাওয়া যাবে।
ক্স বাড়ির সদস্যদের প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর গুলো শিখিেেয় দিন।
ক্স ছেলেমেয়ে ছোট থাকলে যার কাছে এই শিশুকে রাখবেন তার প্রতি আপনার আস্থা নিশ্চিত করুন।
ক্স অফিসের ব্যাগ রাতে গুছিয়ে রাখুন।
ক্স নোটবুক লিখুন সেই অনুযায়ি আগে পরে কাজ করুন।
অফিস আদালতে যারা কাজ করেন তারা মনে রাখবেন অফিস আর বাড়ি যেন এক হয়ে না যায়। অফিসের কাজ বাড়িতে না আনা ভালো। প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন করুন।

কর্মব্যস্ত নারীর সুস্থ থেকে সফলভাবে কাজ করার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা উচিত। গবেষকদের মতে সকালে ঘুম থেকে উঠে Ñ
ক্স কয়েকদানা কালোজিরা খাবেন, পাশাপাশি সামান্য মধু মিশিয়ে উষ্ণ লেবুর রসের শরবত।
ক্স কাজের চাপে সকালে নাস্তার সুযোগ কম থাকে, তবুও সেটাকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ রাতে আটÑ দশ ঘন্টা শরীর খাবার থেকে বঞ্চিত থাকে। অনেককেই অফিসে এসে বলতে শোনা যায় তাড়াহুড়ো করে নাস্তা খাওয়া হয়নি।
ক্স সকালে ডাল রুটি, সব্জী ডিম অথবা সব্জী খিচুড়ি খেতে পারেন।
ক্স কৃত্রিম চিনি না খেয়ে ফলের জুস পান করলে হজম ভালো হয়, বিভিন্ন ইনফেকশন ও স্বাস্থ্যগত সমস্য দূর হয়।
ক্স দুপুরের খাবার পরিমিত খাবেন। সালাদ, রুটি, বা অল্প ভাত, সব্জী, মাছ হতে পারে।
ক্স গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখতে Ñ খেজুর, কাজু বাদাম, কাঁঠালের বীজ খেতে পারেন।
ক্স কিছু সময় পরপর দিনে কমপক্ষে সাত/ আট গ্লাস পানি খাবেন।
ক্স প্রতিদিন মাছসহ ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাবেন।
ক্স রাতের খাবার হালকা খেতে হবে। সব্জী, মুগীর মাংশ বা ছোট মাছ দিয়ে রুটি সাথে স্যুপ বা সালাদ রাখতে পারেন।
ক্স মাতৃত্বজনিত কারণে পঁয়ত্রিশ বছর পরেই মেয়েদের ক্যালসিয়াম ঘাটতি দেখা যায়। তাই স্বামি সন্তানের পাশাপাশি প্রতিদিন ডিম, একগ্লাস দুধ খাবেন।
ক্স কর্মব্যস্ততার মধ্যে চা, কফি আপনাকে চাঙ্গা রাখবে তবে খালি পেটে খাবেন না।
ক্স অ্যালকোহল বা ক্যাফেইন গ্রহন করা উচিত না।
ক্স রাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমিয়ে পড়বেন, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবেন।
ক্স শরীর সুস্থ রাখতে সুতি, ঢিলাঢালা, আরামদায়ক পোশাক পরতে হবে।
শারীরিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে রূপচর্চা করতে হবে। প্রতিদিন হাটাসহ আধাঘন্টা ব্যায়াম করবেন। কাজের মাঝে দুই আড়াই ঘন্টা পর পাঁচ থেকে দশ মিনিট হাটাহাটি/বিশ্রাম করবেন। কর্মস্থলে ডেস্কে বসার জায়গাটি আরামদায়ক কিনা দেখে নিবেন। যাদের প্রতিদিন ঔষধ খেতে হয় তারা ঔষধ ডাইনিং টেবিলে রাখুন, কিছু ঔষধ ভ্যানিটি ব্যাগে রাখুন এবং খেতে ভুলবেন না। মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সব ঔষধ কিনে নেবেন যেন হঠাৎ ফুরিয়ে গিয়ে বিড়ম্বনায় না পড়েন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, কোন ধরনের অসুখকে শরীরে পুষে রাখবেন না তা যত ছোট হোক না কেন। কারণ তা ভবিষ্যতে জটিল আকার ধারণ করে। কর্মব্যস্ততার মাঝেও বিনোদনের ব্যবস্থা রাখবেন যাতে আপনি মানষিকভাবে ভালো থাকেনÑধর্মীয় অনুভূতিসহ, বই পড়া, গান শোনা,গান গাওয়া, মেডিটেশান, ভ্রমণ এসবের সাথে থাকবেন। প্রিয় পাঠক Ñ মা বোনেরা এতক্ষণ যা আলোচিত হলো তা আমাদের অনেকেরই জানা। শুধু স্মরণে রেখে, উদাসীন না থেকে, মেনে চলুন, সুস্থ থাকুনÑ

আখতার বানু বীণা
সহকারী অধ্যাপক
মাদার বখশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ
রাজশাহী Ñ ৬২০৭
মোবাইলÑ ০১৮৬০৪৫৯০৬৯
০১৭১৫ ৮৪২২৬৪

 

 

 

 

 

তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সন্তানকে সতর্ক রাখতে পরিবারের ভূমিকা

প্রিয় পাঠক আমারা সকলেই জানি যে, প্রযুক্তি আসলে বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে মানুষের প্রায়োগিক কাজে লাগানোর উপায় হলো প্রযুক্তি। আর এই প্রযুক্তি মানুষ তার উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করছে। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর যে সমস্ত আধুনিক যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো হলো- রেডিও , টেলিভিশন , স্মার্ট ফোন , টিভি , ল্যাবটপ , ট্যাব , সাথে ইন্টারনেট , স্যাটেলাইট সিস্টেম এসব। বর্তমানে এই প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বত্র। সারাবিশ্বে , জীবনের প্রতি মূহূর্তে। দৈনন্দিন জীবন যাপনের সাথে জড়িয়ে আছে প্রযুক্তি।
গান শোনা , ছবি তোলা , সিনেমা নাটক দেখা , ভিডিও করা , ইন্টারনেট ব্রাউজিং , লেখালেখির কাজ সহ, নাগরিক সভ্যতায় , শিক্ষাক্ষেত্রে, চিকিৎসাক্ষেত্রে , শিল্পক্ষেত্রে , মহাশূন্যের রহস্য উদঘাটনে, পরিবেশ , আবহাওয়া , ব্যাংক শিল্প ও সংস্কৃতিতে , সর্বত্র। মোটকথা আমরা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছি। সামান্য সময়ের জন্যও আমরা প্রযুক্তি ছাড়া চলতে পারিনা। ব্যক্তিগত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মানুষের জীবন যাত্রাকে সহজ করেছে , করেছে জ্ঞান চর্চায় প্রতিটি দেশের মানুষ এবং দেশকে সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী । পরিবর্তন এনে দিয়েছে। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। অসাধারণ বিপ্লব ঘটেছে।
প্রযুক্তি নির্ভর এসব যন্ত্র গুলো প্রায় সবার বাড়িইে আছে। আমরা প্রাপ্ত বয়ষ্করা সারাদিন ব্যস্ত থাকি মোবাইল আর কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নিয়ে। শিশুরা একা একা থাকছে। স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাদের হাতেও তুলে দেয়া হচ্ছে স্মার্ট ফোন , কম্পিউটার , ল্যাপটপ এসব। ছোটরাও প্রযুক্তির হাতে বন্দী।
আর আধুনিক জীবন যাপনের তাগিদেও আমাদের প্রায় সকলেরই প্রযুক্তির প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়েছে হচ্ছে। তবে অন্ধ ভালোবাসা অনেক ক্ষেত্রে হতে পারে হিতে বিপরীত। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও প্রযুক্তিতে আসক্ত। কম্পিউটার , ল্যাপটপ, স্মার্টফোন , গেমিং ডিভাইস কোনটাই শিশুদের অজানা নেই। তবে এই আসক্তি বড়দের জন্য যেমন সমস্যার কারণ। ছোটদের বেলায় আরও ভয়ঙ্কর। কারণ মাত্রারিক্ত এসব যন্ত্র ব্যবহারের ফলে মানুষ শারীরিক , মানসিক এবং সামাজিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেÑ রেডিয়েশনের ফলে ধীরে ধীরে চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কোন কাজে আগ্রহ নাই। কায়িক পরিম্রম , খেলাধুলা করতে চায়না। পরিকল্পনা ও উচ্চতর চিন্তা থেকে দূরে থাকছে। ঘুমের ওপর চাপ পড়ছে , প্রেসার বাড়ছে , হতাশাগ্রস্থ হচ্ছে। বিরতিহীনভাবে গেম খেলা ও এসব যন্ত্র ব্যবহারের কারণে খিঁচুনী বা স্নায়ুরোগ দেখা দিচ্ছে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমছে। মস্তিস্কের অ্যামিগডালার মত অঞ্চলের স্নায়ু জালিকা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে ভয় ও দুঃশ্চিন্তার সাথে শিশু জড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের সাথে সময় কাটাতে চাচ্ছেনা। সামাজিক মেলামেশাতেও পিছিয়ে পড়ছে। লখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ছে। নিয়মিত ব্যায়্যাম খেলাধুলা মুক্ত চিন্তার পথে তারা থাকছেনা।
এগুলো মানসিক রোগ। বিকারগ্রস্থ মানসিকতা নিয়ে শিশুরা সামাজিক অপরেেধ যুক্ত হচ্ছে। নানা ঘটনার সাথে। কিশোর অপরাথের সংখ্যা বাড়ছে। এখন বিষয়টি হলো শিশুরা যে গতিতে প্রযুক্তির সাথে চলছে তা কী আমরা রোধ করবো ? না সেইটি করা ঠিক হবেনা। শুধু প্রযুক্তি না সবকিছুরই ভালো মন্দ দিক আছে। তাই প্রযুক্তির মন্দ দিকগুলো থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। তার জন্য পরিবারকে হতে হবে সচেতন।
সন্তানদের মাঝে প্রযুক্তির ভালো মন্দ দিক তুলে ধরতে হবে। কতটুকু ব্যবহার করা উচিত তার ধারনা দিতে হবে অভিভাবকদের। সময় নির্ধারন করে দিতে হবে। পর্যবেক্ষন করতে হবে তারা কী করছে , কী দেখছে। প্রযুক্তির কোন বিষয়গুলো ব্যবহার করতে হবে। ফেসবুক কী ? পর্ণ সাইট কী ? কেন ব্যবহার করা ঠিক না ? বিষয়গুলো নিয়ে সন্তানদের সাথে বন্ধুর মত আলোচনা করতে হবে। তাহলে তারা ক্ষতিকর দিক থেকে দূরে থাকবে। খেয়াল রাখতে হবে শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো ধরনের বিপদ বা আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে কিনা ?
শিশুর সময় কাটে টিভির কার্টনে নয়তো মোবাইল ফোনে , অথবা টিভি কম্পিউটার বা ল্যাপটপে। শিশুদের চঞ্চলতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বসিয়ে দেই মোবাইল ফোনে। আবার অনেক মা শিশু খেতে চায়না তখন হাতে তুলে দেন মোবাইল বা ট্যাব। ইউটুবে গান শুনতে শুনতে বা কার্টুন দেখতে দেখতে তারা খায়।
এসবকে বলা হচ্ছে আসক্তি। মনে রাখতে হবে যত বেশি আসক্ত হবে তত বেশি শিশুকে সঠিক পথে ফেরাতে কষ্ট হবে।
এসবের কারণে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে হতে হবে সচেতন করতে হবে কিছু মৌলিক কাজ। সেগুলো হলো-
ক্স একটা নিদিষ্ট সময়ে বন্ধ রাখুন প্রযুক্তির ব্যবহার
ক্স ইলেক্ট্রিক বা মোবাইল পণ্য ব্যবহার কম করুন
ক্স বিনামূল্যে ওয়াইফাই ব্যবহার না করা ,কারণ এই ওয়াইফাই নিরাপদ নয়
ক্স সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো অবাধে ব্যবহার না করা। এক্ষেত্রে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা। এতে শিশু কী দেখছে তার ওপর অভিভাবক নজরদারি করতে পারবেন।
ক্স কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ ইনস্টল করুন। প্যারেন্টাল সেফ ব্রাউজার একটি অ্যাপ আছে , এটি ইনস্টল করা হলে শিশু অ্যাডাল্ট কিছু দেখতে পাবে না।
ক্স চাইল্ড ভারসন নামে একটি অপসন আছে। এই অ্যাকাউন্টের ব্যবহারে শিশুরা কী করছে অভিভাবকরা তদারকি করতে পারবেন
ক্স দূর্বল ও সহজ পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করা
ক্স শিশুর সাথে আপনিও ইন্টারনেট ব্যবহারে অংশ নিন। শিক্ষামূলক বিষয় দেখতে উৎসাহিত করুন। পাশাপাশি সতর্ক হোন আপনি কী দেখছেন সে বিষয়ে।
ক্স সন্তানকে সময় দিন
ক্স পরিবারের সদস্যদের ধর্মীয় বিষয় এবং সহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করুণ এতে মন ভাল থাকবে
ক্স ছুটির দিনগুলোতে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যান
ক্স একটা গাইড লাইন তৈরি করুন। গোসল করা, খাওয়া , ঘুম , কতক্ষণ লেখাপড়া করবে ,ইন্টারনেট ব্যবহার করবে সবকিছুর জন্য।
ক্স বাড়িতে খেলাধূলাসহ গল্পের বই পড়নোর ব্যবস্থা করুন। একটা সময় ছিল শিশু কিশোররা মাঠে নানা খেলায় মেতে থাকতো। এখনও এমন ব্যবস্থার সাথে রাখার চেষ্টা করুন।
আসলে প্রযুক্তি ছাড়া আমরা চলতে পারছি না। প্রযুক্তির সাথেই আমাদের থাকতে হবে তবে প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে শিশুকে বাঁচিয়ে। আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই এদের জন্য আমাদেরই সচেতন হতে হবে।
আর প্রযুক্তি পণ্য বা ফেসবুকই সমস্যা না । সমস্যা হলো আমরা কিভাবে ব্যবহার করছি। তবে এর জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। যার প্রথম পদক্ষেপ নেবেন পরিবারের সদস্যরা।
আখতার বানু বীণা
সহকারী অধ্যাপক
মাদার বখ্শ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ , রাজশাহী
মোবাইল – ০১৮৬০৪৫৯০৬৯
০১৭১৫৮৪২২৬৪