এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গিকার হোক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষার

আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

আবুল কালাম আজাদ

মহান বিজয় দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। বিজয়ের অনুভূতি সব সময়ই আনন্দের। তবে একই সঙ্গে দিনটি বেদনারও, বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের জন্য। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের স্বাধীনতা।

আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের; যেসব নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের। এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য়। যাদের রক্ত এবং আত্মত্যগে এই স্বাধীনতা পেয়েছি জাতি তা আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। ত্রিশ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি।

শুধু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তো নয়, বাঙালি প্রাণপণ যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে সেই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে। অঞ্চলভিত্তিক খণ্ড যুদ্ধজয়ের দু-একটি দৃষ্টান্ত অতীতে থাকলেও ভাষাভিত্তিক বাঙালিত্বের পরিচয়ে এবং বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে এমন শৌর্য-বীর্যময় বিজয় লাভ বাঙালির জাতীয় জীবনে আগে কখনো ঘটেনি।

অথচ ১৯৭১ সালের এ যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ, ভোটযুদ্ধে জয়ী শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির ওপরে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা যুদ্ধ।
এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি বিজয়ের অর্ধ শতক। মহার্ঘ্য এই অর্জন নিয়ে আমাদের আনন্দ ও শ্লাঘা পর্বতপ্রমাণ। কিন্তু বিরাট এই পর্বতের ভিত্তি রচিত হয়েছে যাদের রক্তের মূল্যে, জাতীয়ভাবে তাদের অবদান কীভাবে এবং কতখানি মুল্যায়িত হয়েছে সেটি খতিয়ে না দেখলেই নয়।

দৃষ্টি ফেরাতে চাই ‘তিরিশ লাখে’র সংখ্যাগত প্রাকারে বন্দি শহিদদের দিকে। মুক্তিযুদ্ধে নানা রকমের অবদানের জন্য এরই মাঝে সরকার নানান স্বীকৃতি, সনদ ও ভাতা প্রদানের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা প্রশংসনীয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ নিয়ে বেশ বিতর্কও তৈরি হয়েছে। এটা হয়েছে সর্বজনগ্রাহ্য নির্ভেজাল মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণে। সরকারের সচিব পর্যায়েও যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম সন্নিবেশিত হয়ে যায়, তখন আর এ নিয়ে মন্তব্য করার কী বাকি থাকে।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করতে পারিনি। এরচেয়ে গ্লানিকর আর কী হতে পারে! পারিনি আরও অনেক কিছুই। আমাদের গীতিকবি বুকের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া গান লিখেছেন ‘দুঃসহ বেদনার কণ্টকপথ বেয়ে শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না’। লিখেছেন, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না’। তা বেশ, তাদের ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না, শোধ হওয়ারও নয়। কিন্তু প্রশ্নটা এইখানে- তারা সত্যিই কতজন ছিলেন? এক দুই তিন চার করে কাঁটায় কাঁটায় ঠিকঠাক সঠিক সংখ্যা না হয় না-ই হলো, তাদের নাম-ঠিকানা, সেইটুকুও কী কোথাও লেখা হবে না?

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের কারণে যারা শহিদ হয়েছেন, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা অথবা অমুক্তিযোদ্ধা শহিদ (সাধারণ মানুষ) যা-ই হন না কেন, সেই শহিদের তালিকাও নেই আমাদের হাতে। বলা হয়, তিরিশ লাখ শহিদের কথা। এই সংখ্যা নিয়েও অভব্য ও অরুচিকর বিতর্ক তৈরির চেষ্টা এ দেশে হয়েছে। এ বিতর্ক যে কোনো প্রকার সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমার প্রবল বিশ্বাস, এখনো নিরপেক্ষভাবে গ্রামে গ্রামে সরেজমিনে হিসাব নিতে পারলে শহিদের সংখ্যা তিরিশ লাখেরও অধিক হবে। তিরিশ লাখের প্রাকার ভেঙে শহিদের প্রকৃত সংখ্যা ও সঠিক পরিচয় লিপিবদ্ধ করার সময় এখনো একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বরং মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা নির্বিশেষে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সকল শহিদের প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানানোর তাগিদ থেকেই লেখাটি।

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহিদদের প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করার পক্ষে জোর দাবি তুলি এবং তাদেরকে ‘তিরিশ লাখের’ সংখ্যাগত প্রাকারের বাইরে বের করে আনি। ‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লিখা রবে না’ গানের এই বেদনা-ধোয়া বানি বুকে ধারন করেই বলতে চাই, ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লিখার উদ্যোগ আজ হোক, কাল হোক, আমাদের নিতে হবে।

দেশের তরে প্রাণ উৎসর্গকারী শহিদদের সঠিক নাম-পরিচয় উদ্ধার শুধু নয়, স্থানীয়ভাবে তাদের নামে বিভিন্ন স্মারক নির্মাণ, স্কুল-কলেজ ও সড়ক-সেতুর নামকরণের উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। শহিদের উত্তর প্রজন্ম এই নামকরণের মধ্যেও দেশের প্রতি তাদের পূর্বপুরুষের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও স্বস্তি খুঁজে পাবে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরই কর্তব্য। যাদের প্রাণের মূল্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয়েছে বিজয়, আমরা পেয়েছি বহু প্রত্যাশিত ও প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা, তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানানোর দায় আমাদের সকলেরই।

স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা হোঁচট খেয়েছে বারবার। বজায় থাকেনি এর ধারাবাহিকতা। ফলে আজও প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি গণতন্ত্র। রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতাও এর বড় কারণ। অন্তত জাতীয় ইস্যুগুলোয় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য থাকা প্রয়োজন হলেও কোনো শাসনামলেই তা দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থই হয়ে উঠেছে মুখ্য।

এটা সত্য যে,-দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে আমাদের। মাথাপিছু আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে যাত্রা শুরু করেছে। মহাকাশ জয় করেছে। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে,। কর্নফুলি টানেল করেছে। এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। জঙ্গিবাদের অপতৎপরতা ঠেকিয়ে রাখা গেছে। এর মূল কৃতিত্বের দাবিদার শেখ হাসিনার সরকার ও জনগণ।

এ দেশের মানুষ ধর্মের নামে সহিংসতা সমর্থন করে না। তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সরকারকে মানবাধিকারের প্রশ্নে হতে হবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গিকার হোক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষার। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে সব বিভেদ ভুলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সেই ঐক্যের ভিত্তিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো আমরা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব-এ প্রত্যাশা সবার। আমাদের লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ীসহ পুরো দেশ-বাসীর প্রতি রইলো মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, গুরুদাসপুর, নাটোর