নভেম্বরের ভৌতিকতা রুখে দিতে হবে

আপডেট: নভেম্বর ২৫, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির

প্রাক-প্রাচীন বিশ্বাসের কিছু ধারা আমরা বয়ে চলেছি, নীরবে সন্তর্পণে। কে জানে এই ব্যাধি আমাদের সহজাত কি না। কারণ এখনো আমরা কথায় কথায় অলৌকিকতার পেছনে হামাগুড়ি দেইÑ কী রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিজীবনে।

অতি নিকট অতীত ১৯৭০ এর ১২ই নভেম্বর আর ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের অনুষঙ্গি ৩রা নভেম্বর। বাঙালির জীবনে দগদগে নিরাময়হীন ঘায়ের মত জাগরুক। প্রথমটি প্রাকৃতিক। পরেরটি আকার বিশিষ্ট মানব সৃষ্ট।

বিশ্বের অনেক ভাষায় ১২ই নভেম্বর, ১৯৭০ এর ঘটনা লিপিবদ্ধ। আমরা যারা কাছে বা দূরে থেকে প্রত্যক্ষদর্শী তাদের কাছে যেন অনির্বাণ হয়ে জ্বলছে। তখনকার দিনে আবহাওয়ার খবর পরিবেশন অনেক সহজ হয়ে গেছে। আর তা গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছাবার কোনো অসুবিধা তেমন ছিলো না। কিন্তু আমাদের লাঠিয়াল ক্ষমতাধররা সেদিকে মনোযোগ দেয়নি। ১৩ই নভেম্বর বিকেলে খবরের কাগজ আসলে দেখা গেল সব বীভৎস দৃশ্য, যা আমরা কল্পনা করতে পারি না। তাদের উত্তরাধিকাররা আজ আবার মাঠগরম করার কাজে দেশের গতি স্তব্ধ করছে। আমরা কিছু মানুষ এদের যুক্তিহীন প্রলুব্ধতায় জীবন বাজি রাখছিÑ বুঝছি না খেটে খাওয়া মানুষের অভুক্ত থাকার কাহিনী।

যে ধর্ম মানবচরিত্র জীবনমুখি করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত তাকে অতিকল্পনার রাজ্যে নিয়ে গিয়ে মানুষকে পাশবিকভাবে হত্যা করাকে কিছু মানুষ ধর্ম বলে স্বীকার করছে। ফলে বাধছে হত্যাযজ্ঞ, লাঠিয়াল প্রবৃত্তি। এইযে আমরা গণতন্ত্রের নামে বয়স অশান্তির পরিবেশ তৈরি করছি তার সামনে ধর্মের মুখোশ আর পেছনে ভোগের পেয়ালা। এখান থেকে আমরা কবে মুক্ত হবো, তার হদিস কে বলবে!

১৯৭০ এর ১২ই নভেম্বর, বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের আগের বছর। তখন সারাদেশে চলছে নির্বাচনের এক আনন্দময় পরিবেশ অবশ্য অতি নগন্য সংখ্যক মানুষ পাকিস্তানি দুরভিসন্ধিতে বুঁদ। তার এক পর্যায়ে আঘাত হানলো দক্ষিণবাংলার উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কত মানুষ-প্রাণী, বৃক্ষরাজি এক রাতে লোপাট হয়ে গেল কেউ জানেনি, আজও তার হিসেব কেউ দিতে পারেনি। আমরা স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিলাম। লাঠিয়াল সরকার আমাদের খোঁজ নেয়নি। পরে লাঠিয়াল সর্দারের আকাশ ভ্রমণে আমাদের দুর্দশাকে দুঃসহ করেছিলো, সে দৃশ্য এখনো আমাদের সচকিত করে।

আমরা আমাদের বিড়ম্বনা দূর করার জন্য নিজেদের শাসন নিজেরাই করতে চেয়েছি। দেশের স্বাধীনতাকামি মানুষ কতভাগ সাড়া দিয়েছে। সেখানে দুর্বৃত্ত ছিলো না তা নয়, তারাই বিদেশি মোড়লদের সহযোগিতায় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে প্রায় সপরিবারে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়।

বাঙালির স্তম্ভত চেতনা জাগ্রত হয়েছে। নানা ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে তারা দেশকে মাতৃসুধা দিয়ে লালন করতে জীবনবাজি রেখে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওই যে গাছেরটা খেয়ে তলেরটা কুড়াবার দুর্বৃত্তরা বেরিয়ে এসেছে। তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা গণতন্ত্রের নামে ৩রা নভেম্বর আর এক নতুন বীভৎস ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমরা তা ভুলিনি।

জগৎজোড়া নানা সংকট। এরই মাঝে বেরিয়ে এসেছে ঝোপ বুঝে কোপ মারার দল। নতুন উপজীব্য গণতন্ত্র। যারা একদা ধর্মের নামে লাঠিয়ালদের কাছে দেশ জিম্মি রেখেছিলো তারা সর্বনাশের ডংকা বাজিয়ে পেছন থেকে টানতে উদ্যত।

যারা কেবল ভোগের জন্য শাসন দণ্ড ধারণ করে বংশ-পরম্পরা সুখের অস্তিত্ব বিস্তার করতে চায়, তাদের কাছে এটা উৎসব হতে পারে, কিন্তু আমরা যেন বহিঃসর্বস্ব আচরণকে নীরবে বহন না করি। আমরা জেগে উঠি এবং নভেম্বরের ভৌতিকতাকে রুখে দেই।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ