বাঙালির জাতিসত্তা নিয়ে কিছু কথা

আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

সাইফুদ্দীন চৌধুরী

আমাদের জাতীয় পরিচয়ের উৎসমুখ চাপা পড়ে আছে আমাদের নৃতাত্ত্বিক এবং জাতিতাত্ত্বিক নানা উপাদান-উপকরণের মধ্যে, একথা প্রমাণিত। তবে এ সত্য অবশ্যই মানতে হবে যে, আমাদের দেশে বিশেষত মানববিদ্যার অন্যান্য শাখার মত, মানবসভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে বিজ্ঞান নির্ভর কথা বলা এখনও বড় শক্ত। গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। গবেষণার এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নেই, আধুনিক বিজ্ঞান ও লাগসই প্রযুক্তির সংযোজন এখনও আমাদের এ সব গবেষণায় আসেনি। দ্বিতীয়ত কূল ভেঙ্গে কুল গড়া, দেশের নদীগুলি ধ্বংস করেছে প্রাচীন কীর্তির ধারক-বাহক সেকালের সমৃদ্ধ জনজীবনের সাক্ষ্য বিস্তীর্ণ জনপদ। অধিকন্তু ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী তো ছিলই। এসব কারণেই এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। পিছিয়ে পড়ে থাকা এই প্রতিকূলতার জন্য আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়ও সঠিকভাবে এখন অব্দি উঠে আসেনি। তাই বলে একেবারে নিরাশ হবারও কারণও নেই। আমাদের প্রাচীনভূমির পরিচয়, ভৌগোলিক তথ্য ও প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শন, নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব প্রভৃতির অনুষঙ্গ মিলে আমাদের অতীত নিয়ে মোটামুটি যে একটা ধারাক্রম তৈরি হয়ে আছে, এজন্য আমাদেরই শুধু নয়, অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরও এই দেশের অতীতের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে।

ভূ-তত্ত্বের প্রাচীনতা থেকে ধারণা করা হয়, এই বাংলাদেশের ভূখণ্ড এক সময়ে জলমগ্ন ছিলÑ বিশেষতঃ এর সমতল ভূমি অংশ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। আনুমানিক ১০ লক্ষ বছর আগে প্লাওসিন যুগে এখানে ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়। কালক্রমে ‘ব’ অঙ্গবিশিষ্ট এই অঞ্চল বঙ্গ বা বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে মৃত্তিকার প্রাচীনতার স্বাক্ষরসহ কোনো প্রামাণিক দলিল আমাদের হাতে যে নেই, সেকথা তো আগেই বলেছি। প্রাচীন ভূমি গঠনকালের উপাত্ত না থাকলেও আমাদের কাছে আট কিংবা নয় হাজার বছর পূর্বে নব্য প্রস্তর বা নবপলীয় যুগের এদেশের মানব বসতির কিছু তথ্য আছে। এই সময়েই এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী ক্লান কিংবা ট্রাইব ছেড়ে ক্রমান্বয়ে কৌমজীবনে প্রবেশ করে সভ্যতার পত্তন করতে শুরু করে।

এই ভূখণ্ডের যারা আদি ক্লান কিংবা ট্রাইব, তারাই বস্তুতঅর্থে আমাদের জাতিসত্তার উ˜্্গাতা। এ প্রসঙ্গে আমি কেবল অস্ট্রিক ভাষা-ভাষী আদি অস্ট্রেলীয় কৌমের নামোল্লেখ করছি, যারা আমাদের আদি ঠিকানা ধারণ করেছে। পরবর্তীকালে যদিও এই ভূখণ্ডে এসেছে কৃষিজীবী ও নগর সভ্যতার ধারক দ্রাবিড়েরা, ‘কিরাত’ নামে পরিচিত মোঙ্গল প্রতিম মঙ্গোলীয়রা, বলিষ্ঠ দেহ, গৌরবর্ণ উন্নত নাসিকার মধ্য এশিয়ার নর্ডিক রক্তধারা নিযে আর্যরা, দীর্ঘ দেহ নিয়ে সেমিটির মুসলমানেরা।

এই ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা আদি অস্ট্রেলীয়রা বিল, ঝিল, নদী, নালার ধারে যে কৃষিজীবী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তার শেকড় ছিল অতি গভীরে প্রোথিত। নদী মেখলা দেশ বলেই কী তারা প্রথম থেকেই স্বতন্ত্র চেতনার অধিকারী? পশ্চিম থেকে উত্তর থেকে যখনই বহিরাগত শক্তি এদেশকে করায়ত্ত করতে চেয়েছে, তখনই প্রচণ্ড প্রতিকূলতার ব্যুহ তৈরি করেছে, স্বকীয়তা কখনই বিনষ্ট হতে দেয়নি। প্রবল বিপত্তি ঘটবে জেনেই তো মেসিডোনীয় বীর আলেকজান্ডার এই অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়নি। আর্যদের অগ্রগমনও প্রথমে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখানকার আদিবাসী অস্ট্রিকভাষী জন যে আর্য সংস্কৃতিকে বিনা প্রতিরোধে গ্রহণ করেনি, তার তো সাক্ষ্য রয়েছে ‘মহাভারতে’র রঘু-ভীমের দ্বিগি¦জয় কাহিনীতে।

খর্বকায়, কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘমুণ্ডু, প্রশান্তনাস, তাম্রকেশের জনগোষ্ঠীর পেশা কৃষি সঙ্গে যুগপৎ শিকারজীবী এই অস্ট্রিকভাষী জনকে বৈদিক আর্যরা দস্যু, অসুর, পিশাচ, স্লেচ্ছ, ভ্রষ্ট, অদীক্ষিত প্রভৃতি বলে নিন্দাবাদ করেছে। ধ্রুপদী সাহিত্য ‘ঐতরেয় আরণ্যক’- এ তো এই জনপদের মানুষের মুখের ভাষাকে পাখির ভাষা বলা হয়েছে। পাখির ভাষায় কথা বলা ‘অসুর’, ‘নিষাদ’ ইত্যাদি অভিধায় সম্বোধিতরাই অস্ট্রিক ভাষা-ভাষী আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠী। বাঙালিদের শঙ্কর চেহারায় যেমন সেই রক্তের প্রবলধারা বহমান, তেমনি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে আজ অবধি তাদের ভূমিকা রয়েছে অক্ষুণ্ন। দক্ষিণ এশিয়ার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট এই দেশটিতে এখনও কৃষিজীবী গ্রাম-সভ্যতা রয়েছে, তার কৃষি থেকে সংস্কৃতির প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে ওই আদি অস্ট্রেলীয় জন। বস্তু-সংস্কৃতির উপাদান না পাবার কথা তো আগেই বলেছি। আমাদের দেহাবয়বের গঠনশৈলী, আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উপাদান, আমাদের সংরক্ষিত শব্দভাণ্ডার তো এক্ষেত্রে কম দলিল নয় একেবারে।

আমাদের স্থান নামে দেখি ‘দহ’-অন্ত্য, অস্ট্রিক শব্দ, যেমন- শিলাইদহ, ঝিনাইদহ, পোড়াদহ, বিড়ালদহ, ‘দী’ অন্ত, যেমন- ঈশ্বরদী, মহোহরদী, নরসিংদী, মাইজদী, মাধবদী, গোপালদী, ‘পুর’ অন্ত্য, যেমন- রংপুর, দিনাজপুর, শাহজাদপুর, রোহনপুর, বিনোদপুর, ‘শাল’ অন্ত্য, যেমন- বরিশাল, (ধান নামে রঘু শাল, ঝিঙাশাল) প্রভৃতি। শাল, পাম, তাম, তার কাম, কুট, পাল, তাল, কাল, কার ইত্যাদি অস্ট্রিক শব্দ স্থাননাম, বস্তু নামে যুক্ত করা হয়। আমাদের দেশে পান লতার মাচার নাম ‘বরোজ’ও অস্ট্রিক শব্দ। ‘বরোজ’ শব্দ থেকে আমাদের অস্বীকার করার কী উপায় আছে যে, সেই আট বা নয় হাজার বছর আগে থেকে এদেশের লোকেরা তাম্বুল বিলাসের বা পান খাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। নদী-নালা, খাল-বিলের আদি-অস্ত্রাল জনের দেশের মানুষের একালের পরিচয়, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। আদি-অস্ত্রাল জনের প্রশান্ত মহাসাগরীয় সভ্যতা প্রভাবিত প্রধান আহার্য, মাছ এই ভূ-খণ্ডের মানুষেরই নয় কেবল, চীন, জাপান, ব্রক্ষ্মদেশ, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের আহার্য তালিকারও শীর্ষে ছিল একদা।

আমাদের দেশের প্রায় সব মাছের নামই অস্ট্রিক ভাষা থেকে এসেছে- ডানকিনা, ভেদা, বাইটকা, রাইখড়া, পাঙ্গাস, খরশল্লা, রয়না, ঘনে, দাঁড়কা, গড়ুই প্রভৃতি। অস্ট্রিক ভাষায় ধান নাম আছে- ঝিঙাশাল, রঘুশাল, বাঁকশাল, তুলাশাল (তুলাশালী), বাঁশমতি, বাঁককাটা ইত্যাদি। অপরদিকে কৃষির ও নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত অস্ট্রিক শব্দগুলো হলো- মই,লাঙ্গল, কোদাল, জোঙাল, দা, ফাল, কেডুয়াল, রিষ, ধুরি, তাঁতরা, ডিঙ্গা, দোনা, দড়ি, কাছি, লগি, দাড়, হাল, পাল, মাস্তল, নোঙ্গর প্রভৃতি। অস্ট্রিক ‘কুর’ বা ‘কোরের’ অর্থ হলো মানুষ। মানুষের হাতে পায়ে রয়েছে কুড়িটি আঙ্গুল। মানুষের এই অঙ্গের বর্ণনা থেকেই ‘কুড়ি’ গণনার উদ্ভাবন, এদেশে অস্ট্রিকভাষারই দান। এভাবে তালিকা প্রণয়ন করলে দেখা যাবে অস্ট্রিকভাষার সিংহভাগ শব্দই এদেশের লোকসমাজে আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। অস্ট্রিক শব্দাবলী যে সংস্কৃতির পরিচয় ধরে রেখেছে, তার সঙ্গে যুগপৎ সম্পর্কিত হয়েছে তার মানসসংস্কৃতি। এই দুইয়ের সম্মিলিত প্রয়াসে সেকালের ওই কৌমজন আদি অস্ট্রেলীয়রাই যে আমাদের জাতিসত্তার ভিত গড়ে তুলেছিল, কী করে সে কথা অস্বীকার করি?

বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী আজকের জনগোষ্ঠীর পূর্ব ইতিহাস বা তার উৎসের কথা বলতে গেলে, আদি অস্ট্রেলীয় জনকেই সর্বপ্রাচীন মাপকাঠি ধরতে হবে। বলা যেতে পারে, তারা বাঙালি জাতিসত্তার যে বীজ নবপলিয় যুগে বপন করেছিলÑ তারই বীজ উপ্ত হয়ে বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে একুশ শতকে এসে মহীরূহ রূপ লাভ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই সে বৃক্ষ পল্লবিত হয়ে উঠেছে।

লেখক : গবেষক, অধ্যাপক (অব.), ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়