ভালোলাগা অক্ষুণ্ন থাক

আপডেট: অক্টোবর ২২, ২০২৩, ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির:


‘এইতো ভালো লেগেছিলো আলোর নাচন পতাায় পাতায়’ পৃথিবীর বয়সের তুলনায় একজন মানুষের জীবৎকালের তুলনা কীইবা হতে পারে। না হয় না। শত সহস্র বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি তার হদিস কে দেবে। মানুষ সপ্রতিভ হয়ে তার পরিবেশ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে লেখনি ধারণ করেছে এই তো সেদিন। অবশ্য তাঁর একটা ধারণা আমরা পাই, তবুও অকাট্য নয়।

ভারতীয় সাহিত্যের উৎকর্ষের যুগে প্রকৃতিকে সামনে রেখে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হয়েছে। তার হিসেব একেবারে অজ্ঞাত নয়। তারপর কিছুটা মঙ্গল সাহিত্যের কবিরা। আমদের ধারণা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রকৃতিকে বরণ করে নিয়ে তার প্রশস্তি রেখে গেছেন, আমাদের অনুভবের জন্য। অবশ্য মধ্যম অনুভব যেমন উন্নত, তেমিন সার্বজনীন। আমাদের লেখা শুরু করেছি প্রকৃতি বিষয় ‘বিচিত্র’ গ্রন্থিকার একটি গানের প্রথম পংক্তি সামনে রেখে। এখানে যে প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে তা বাংলার শ্যামল প্রকৃতি নয়। এক উষ্ণ ভূখণ্ডের লাল মাটির পরিবেশের বর্ণনায় যে মাধুর্য অন্তহীন সৌন্দর্য তার তুলনা কোথায়? নিজের যা আছে আমরা তাতে পরিতৃপ্ত নই। বিদেশ-বিভুঁয়ের চিত্র তুলে এনে সেখানে সৌন্দর্য খুঁজি। এই যে মরু কিংবা মেরু অঞ্চল সেখানে সবুজের সাক্ষাৎ নেই, সেখানেও মানুষ থাকে এবং তার সৌন্দর্যে নিজেদের ভাগ্যবান ভাবে। আর আমরা সৃষ্টির সেরা প্রকৃতিক সৌন্দর্যের দেশে অবস্থান করে সুন্দরের সন্ধান পাই না। এর কারণ আত্মতৃপ্তি থেকে নিজেকে নির্বাসিত করা। যা আছে তাই নিয়ে পরিতৃপ্তি পাই না। এখান থেকে অবশ্যই মুক্ত হতে হবে আমাদের। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘসময় পূর্ববাংলার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে এর সমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন বসাবস করেছেন। কোথাও কখনো অতৃপ্তির কোনো চিহ্ন রেখে যাননি। যা কিছু দেখেছেন, তাকেই মনে করেছে অপার্থিব।

শতবর্ষের কিছু আগে রবীন্দ্রনাথকে বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছিলো ‘পতিসরে’। পতিসর একদা রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার আত্রাই রানীনগর অঞ্চলের একটি গ্রাম। রবীন্দ্রনাথ যখন এখানে আসেন তখন যোগাযোগের মূল মাধ্যম ছিলো জলপথ যে পথ মাঝে মাঝে সংকীর্ণ হয়ে আসতো। রবীন্দ্রনাথ নদীপথে পতিসর এসে থাকতেন অনুল্লেখ্য এক কুঠিবাড়িতে। তার পাশে দিয়ে ছিলো একটি নদী। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। (চৈতালির ভূমিকায়: “পতিসরের নাগর নদী নিতান্তই গ্রাম্য। অল্প তার পরিসর, মন্থর তার স্রোত। তার একধারে দরিদ্র লোকালয়, গোয়ালঘর, ধানের মরাই, বিচালির স্তূপ। অন্যতীরে বিস্তীর্ণ ফসল কাটা শস্য ধূধূ করছে। কোনো এক গ্রীষ্মকালে এইখানে আমি বোট বেধে কাটিয়েছি।” আজকের নদীহীন পতিসর আমাদের ভাবনাকে রুদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথ তা দেখে বিরক্ত হননি। বরং প্রকৃতির সেই পরিবেশকে স্বাভাবিক অনুভবে তার পরিচয় ব্যক্ত করেছেন। অতি আধুনিকায়তায় এসব দৃশ্য আমাদের রহস্য রাজ্যে নিয়ে যায়।

না আমারা সেখানে যাব না। জগতের তুলনায় বাংলাদেশে রহস্য রাজ্যের সৃষ্টি একেবারে নগন্য নয়। তবুও এসব পরিবর্তনশীল। স্থায়ী সৌন্দর্যের আধারগুলো যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। শ্যামল সবুজের মাঝে যেন মরুময়তা সৃষ্টি না করি।

লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ