মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারী

আপডেট: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক রাশেদা খালেক

‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’

কোনো কালে একা হয়নি ক’জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয়লক্ষী নারী।’

কবি যথার্থই বলেছেন। এ জগৎ সংসারে বিজয় লক্ষ্মী নারী রয়েছে বলেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারী শুধু শক্তি ও প্রেরণাদাত্রী হিসেবেই কাজ করেননি পুরুষের পাশাপাশি নারীর তরবারিও ঝলসে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশের আপামর জনগণের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু পুরুষেরাই করেনি, করেছে নারীরাও। কেউ অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে, কেউ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষা করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, মনোবল যুগিয়েছে, কেউ বর্হিবিশ্বে স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিশ্বমত গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত থেকেছে। এমনিভাবে এ দেশের সকল মানুষ (শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক নরপশু আলবদর, আল শামস্ ও রাজাকার ছাড়া) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালী নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদানকে কেবল বীরাঙ্গনা হিসাবে ও শহীদের মা-বোন-স্ত্রী হিসাবে দেখা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা কত লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছেন, নির্যাতিতা হয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষা বা ভাত রেধে খাইয়েছেন এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু কতজন নারী প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, কিভাবে যুদ্ধ করে শত্রুকে খতম করেছেন, শহীদ হয়েছেন এসব প্রসঙ্গ খুব কমই আলোচনায় আসে। গবেষকরাও এদিকে খুব একটা নজর দেননি। তবে আশার কথা ভরসার কথা বর্তমানে ‘নারীমুক্তি যোদ্ধাদের’Ñ আবিষ্কার করার মহতী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে। এদিক থেকে ‘সম্মিলিত নারী সমাজ’ এবং ‘মহিলা সমাজ’ গৌরবময় ভূমিকা পালন করছেন। পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনের দৌলতে আমরা বেশকিছু নারীমুক্তি যোদ্ধাদের কথা জানতে পেরেছি স্বাধীনতার ২৬ বছর পরও। এমন আরো কত নারী মুক্তিযোদ্ধা দেশের আনাচে-কানাচে অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছেন যাদের কথা আমরা এখনো জানতে পারি নি।
মুক্তিযুদ্ধে নারী সংগঠক হিসাবে কাজ করে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা হচ্ছেনÑ বেগম তাইবুন নাহার রশিদ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম বদরুন্নেসা আহমদ, নূরজাহান মুরশিদ ও বেগম মতিয়া চৌধুরী। সহ-সংগঠক হিসাবে কাজ করেছেনÑ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বেগম সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, বেগম রাফিয়া আক্তার ডলি, আইভি রহমান, অধ্যাপিকা মমতাজ বেগম, বেগম হোসনে আরা মান্নান, মালেকা বেগম, আয়শা খানম, বেবী মওদুদ, মুশতারি শফি প্রমূখ নারী নেত্রীরা।
প্রথমেই ‘কাঁকন বিবি’র কথা তুলে ধরছি। অসীম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা ‘কাঁকন বিবি’। কাঁকন বিবি জাতে খাসিয়া। সুনামগঞ্জের মেয়ে। কাঁকন বিবি পাঁচ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। তখন সেখানকার কমান্ডার ছিলেন মীর শওকত আলী ও সাব-সেক্টর কমান্ডার হেলাল উদ্দিন। কাঁকন বিবি প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচর্যার কাজ করেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, অস্ত্র, গুলি ও সংবাদ সরবরাহ করেন। ভিক্ষুকবেশে তিনি এই কাজ করতেন। আগস্ট মাসে জর্জিয়া ব্রিজ ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল কাঁকন বিবির। কাঁকন বিবি যুদ্ধ করেছেন মহরতপুর, কান্দাগাঁও, বসরাই, সেংরাটিলা, বেনিংগাও, নূরপুর, দোয়ারা বাজারে। ২০টি সম্মুখ যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতিত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে ডিসেম্বর মাসে ‘বুদাই’ নামক এক রাজাকার তাকে ধরে ফেলে। শুরু হয় তার উপর অত্যাচার। গরম লোহার রড দিয়ে ছিদ্র করা হয় দেহের নানা জায়গা। সাতদিন ধরে চলে এই নির্যাতন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার নাম করে কাঁকন বিবি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। নিজ এলাকায় তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা বেটি’ নামে পরিচিত। দেশ স্বাধীনের ছাব্বিশ বছর পর কাঁকন বিবি আবিস্কৃত ও সংবর্ধিত হন।
খাসিয়া নারী কাঁকেটের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। কাঁকেট মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তিন মাস সেনাক্যাম্পে বন্দি ছিলেন।
এবার বলবো লড়াকু গারো নারী সন্ধ্যারানী সাংমার কথা। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর জানজালিয়া গ্রামে ১৯৫৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জমির মারাক। মাতার নাম মিংরি। বর্তমানে তিনি নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নলচান্দ্রা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান সন্ধ্যারানী সাংমার মধুপুর জলছত্র মিশন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে ভুটিয়া হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পিতা ছিলেন কৃষক। মা আদিবাসী সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে ঘরে ও কৃষি ক্ষেতে কাজ করতেন। সন্ধ্যারানী ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ হালুয়া ঘাটে জয় রামকুড়া খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালে নাসিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পাকিস্তান হানাদার বাহিনি ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হলে সন্ধ্যারানী সাংমা তার দূরসম্পর্কের এক বোন ভেরেনিকা সিমসাংয়ের সাথে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার চাপাহাতি গ্রামে পৌঁছেন। এ সংবাদ শুনে হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া নার্সিং হাসপাতালের ডাক্তার প্রেমাংকুর রায় সন্ধ্যারানী সাংমা ও ভেরেনিকা সিমসাংকে ১১নং সেক্টরের অধীনস্থ ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এই হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন ১১নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নান ও ডাঃ প্রেমাংকুর রায়। হাসপাতালটির অবস্থান ছিল বাঘমারা ক্যাম্প থেকে চারশত গজ দূরে। সন্ধ্যারানী সাংমা ১৯৭৩ সালে নেত্রকোণা জেলার নলচাপা গ্রামের চার্চিল কুবিরকে বিয়ে করেন। তিনি দুই পুত্র এক কন্যা সন্তানের জননী। কমলাকান্দা এলাকায় তিনি একজন আদিবাসী নারীনেত্রী হিসাবে সুপরিচিত। সন্ধ্যারানী সাংমা মুক্তিযুদ্ধে গারো নারী হিসেবে ‘অনন্যাশীর্ষ দশÑ২০০৮’ পুরস্কারে ভূষিত হন।
ভেরেনিকা সিমসাং টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার আমলীতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিশ্বনাথ চাম্বুগাং। মাতা কামিনী সিমাসাং। ভেরেনিকা ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালের নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে ছিলেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ভেরেনিকা ও তাদের মেডিকেল টিম শেরপুর ও জামালপুরে প্রবেশ করেন। শেরপরে ২৯ দিন অবস্থান করে জামালপুরের বিভিন্ন যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেরেনিকা সিমসাং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাপ্রদানরত অবস্থায় ডিসেম্বরে জামালপুর হানাদারমুক্ত হলে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বাড়ি ফেরেন। ভেরেনিকা সিমসাং ১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের বেড়িবাইদ গ্রামের খগেন্দ্র সাংমা ডিব্রাকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক জীবনে তিনি দুই কন্যা এক পুত্র সন্তানের জননী ছিলেন। ২০০৫ সালে ১৩ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয় (জনকণ্ঠ, ২১.১২.২০১৮)।
মুক্তিযুদ্ধে দুইজন নারী ডা. সেতারা বেগম ও তারামন বিবিকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৪ সালের ২৫ নভেম্বর ভোরের কাগজে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আমরা তারামন বিবির কথা জানতে পারি। তারামন বিবি বলেছেনÑ ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গেছি। কি পাব আর কি পাব না এই চিন্তা করে যুদ্ধে যাই নি। যুদ্ধ করেছি দেশের স্বাধীনতার জন্য।’ আমাদের মা-বোনেরা তথা নারী মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন কোন তঘমা বা খেতাবের জন্য নয়। তারা লড়াই করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
বিজয়ের এই দিনে সালাম জানাই ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রতি। কৃতজ্ঞতা মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী ও দুই লক্ষাধিক সম্ভ্রমহারা মায়েদের প্রতি। বিনম্র শ্রদ্ধা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার প্রতি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক; চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী।