মুক্তিসেনা : তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না

আপডেট: অক্টোবর ১২, ২০২৩, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ

নৌ-কমান্ডো মো. আজিজুল আলম:


স্বভাবতই আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে। তা হলো মানুষ সবচাইতে ভালোবাসে কাকে? মা বাবাকে? ভাই বোনকে? স্বামী স্ত্রীকে? প্রেমিক প্রেমিকাকে? অনেককে বলতে দেখেছি, প্রাণাধিক বা প্রাণাধিকা, তোমার জন্য মরতেও পারি, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না ইত্যাদি। আসলে কি তাই? আমার ধারণা মানুষ সবচাইতে বেশি ভালবাসে নিজেকে, নিজের জীবনকে। যখন বাবা-মায়ের সামনে সন্তান মারা যায়, সন্তানের সামনে মা-বাবা মারা যান কিংবা স্বামীর সামনে স্ত্রী অথবা স্ত্রীর সামনে স্বামী, জোড়ের ভাইয়ের সামনে ভাই তখন প্রায় সকলেই নিজের মরণও কামনা করে থাকে। কিন্তু মরতে পারে কি? ইচ্ছে করলেই মরা যায় না বা মরা কি সম্ভব? তবে মানুষ আইনের ভয়ে বা লোকাচারের ভয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেয় না। মানুষের স্বজন বিয়োগের তাৎক্ষণিক ব্যথাটা ক্রমশই প্রশমিত হতে থাকে। কারণ সময় সবকিছু সংহার করে। পাক-ভারত উপমহাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ইতোপূর্বে সহমরণের প্রথা চালু করা হয়েছিল। এটা কি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে শাশ্বত রূপ দেওয়ার জন্য? স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীর সতীত্ব রক্ষা বা জীবন বিপন্ন হওয়ার হাত হতে সমাজকে রক্ষার জন্যই সে সময়ের সমাজপতিরা এ ধরনের পৈশাচিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। কিন্তু ক’জন স্ত্রী স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় সহমরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? প্রায়শই দেখা গেছে, সদ্য বিধবা স্ত্রীকে টেনে হিচড়ে স্বামীর চিতায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ওই বর্বরোচিত প্রথা বাতিল করতে সমাজপতিরা বাধ্য হয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে কম নিগ্রহ পোহাতে হয়নি। তবে সবকিছুর মাঝে আবার ‘ব্যতিক্রম’ বলেও একটা কথা থাকে। উপরোল্লেখিত আমার প্রশ্নবোধক চিহ্নের মানব-মানবীদের মাঝেও যে একেবারে ব্যতিক্রম ছিল না বা নেই তা কিন্তু নয়। যেমন বাবা-মাকে লাঞ্ছিত বা নিগৃহীত হতে দেখলে কোনো না কোনো সন্তান জীবনবাজি রেখে এগিয়ে আসে, বোনকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করতে একটি না একটি ভাই অগ্রসর হয়, তেমনি মাতৃভূমির সম্মান, মর্যাদা বা স্বাধীনতা যখন বিপন্ন হতে থাকে তখন দেশমাতৃকার কোটি কোটি সন্তানের মধ্যে কিছু সংখ্যক সন্তান দেশমায়ের চরণতলে নিজেকে বিসর্জন দেয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হওয়ার পর ক’জন ভারতবাসী বিশ্বাসঘাতকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে লড়াই করেছে? বরং সুবিধাভোগীরা তখন নিজেদের আখের গোছানোর জন্য ইংরেজদের তোসামোদি ও প্রভু বন্দনায় মেতে উঠেছে। আর এই চরম প্রতিকূলতা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে বিচ্ছিন্নভাবে মাতৃভূমির মুক্তির জন্য অসংখ্য দেশপ্রেমিক লড়াই করে আত্মাহুতি দিয়েছেন। যেমন অগ্নিযুগের বিপ্লবী পুরুষ ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ, সিধু, কানু, বিরসা মুন্ডা, বাঘা যতীন, রাসবিহারী, তারকেশ্বর, প্রফুল্ল চাকী, উল্লাস কর, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ সিপাহী বিদ্রোহে অসংখ্য মুক্তি পাগল দেশপ্রেমিক নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন (অগ্নি যুগের এ সকল বিপ্লবীদের নিয়ে এ লেখকের আর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ‘তোমরা অজয়, অমর, অক্ষয়’শিরোনামে)। এ ছাড়া ‘৪৭এর তথাকথিত স্বাধীনতার পরে ইলামিত্রসহ অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষকে অমানুষিক ও অবর্ণনীয় নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এরই মাঝে নেতাজি সুভাষ বসু স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেছিলেন,’তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। ‘তারপরেও তিনি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে ‘আজাদ হিন্দ মুক্তিফৌজ’ গঠন করলেও সেখানে পাক-ভারত সমতলের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল একেবারে নগণ্য। সেখানে প্রধানত আরাকান ও চট্টলার যুব সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। যদি কোনোদিন এ বিষয়ে গবেষণা করা হয় তবে দেখা যাবে ১৯০ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মাথায় নিয়ে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছে। শত কোটি মানুষের দেশে ইতিহাসকারদের মতে ওই সুদীর্ঘ সময়ে স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মহতি দিয়েছেন মাত্র ১০ লক্ষ মুক্তি পাগল মানুষ। তবে হ্যাঁ,১৯৪৬ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারতের পক্ষে জনসমর্থন জানানো হয়। তারপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান থেকে ভারতে ও ভারত থেকে পাকিস্তানে আসা-যাওয়ার পথে উগ্র সম্প্রদায়িকতার বলি হয়েছে ২০ লক্ষ সাধারণ মানুষ। এটাকে আত্মাহুতি বলা যায় না বরং এটা ছিল প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলাফল। মধ্যবিংশ শতাব্দীর সেই বিষবাষ্প আজও ভারতবর্ষের মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
১৯৪৭ সালে তথাকথিত স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলার স্বাধীনতার জন্য তেমন কোনো সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। যদিও স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের জন্মের পরে আন্দোলনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরেও নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে তা দানা বেঁধে ওঠেনি। ১৯৫৪ সালেও আরো একবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু নেতৃত্বের স্বার্থবাদীতা ও পক্ষপাতিত্বের কারণে বাঙালিকে সে সুযোগ হারাতে হয়েছে। কালের পরিক্রমায় গোপালগঞ্জের এক নিভৃত পল্লীতে বেড়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার জাগরণী মন্ত্র শোনাতে থাকেন বাঙালি জাতিকে। অবশেষে তিনি যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন তখন অস্ত্র হাতে ক’জন স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন? তখন এদেশের লোক সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। যুদ্ধ শুরু হলে ১ কোটি মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। বাকি সাড়ে ছয় কোটি মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড রকম মৃত্যুঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ক’জন মানুষ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল? একাত্তরের মার্চ থেকে আরম্ভ করে আগস্ট পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতে গোনা। অধিকাংশ মানুষ নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে এখান থেকে সেখানে কিংবা সেখান থেকে এখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। আগস্ট মাস হতে দেশের ভেতরে বিভিন্ন ঘাতক বাহিনী যেমন রাজাকার, আল বাদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্যদের আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে অনেক যুবক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সেখানেও তাদের জীবন নিরাপদ ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার মুখে সুবিধাভোগীরা বিপন্ন বোধ করার ফলে যুব শিবিরে নাম লেখাতে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা সেজে দেশের অভ্যন্তরে এসে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে থাকে। অনেকে যুব শিবিরে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় দেশ শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। যদি এদের সবাইকে সশস্ত্র যোদ্ধাও ধরা হয় তাহলেও ১৯৮৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের দলিল মোতাবেক সর্বপ্রকার মুক্তিযোদ্ধার মোট সংখ্যা ছিল ১,০৫,৫০৫ জন (বিমান বাহিনীর মুক্তি সৈনিকের তথ্যটি তখন জানা যায়নি)। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সকল যুবকরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ভারতে অবস্থান করছিল তারা স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিয়ে এদেশে এসে হত্যা, রাহাজানি, লুটপাট এবং এমন কোনো গর্হিত কর্ম নেই যা তারা করেনি। এতে করে মুক্তিযোদ্ধারা যারা ছিল দেশের মানুষের মাথার মুকুট তাদের ভাবমূর্তি রাতারাতি ধুলোয় মিশে গেল। কালের সাক্ষী হিসেবে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান তৈরি করেছিলেন’তোরা আবার তোরা মানুষ হ’ , ‘ওরা ১১ জন’ এর মত কালজয়ী মুক্তিযুদ্ধের ছবি। তারপরে এসেছে আলোর মিছিল, একাত্তরের যীশু, আগুনের পরশমণি, গেরিলা’র মতো ছায়াছবি। শ্রদ্ধেয় নির্মাতারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখার মানসে ছবিগুলো নির্মাণ করেছিলেন। তাতে সমাজের একটি খণ্ডাংশের চিত্র পাওয়া যায় কিন্তু পুরো সমাজের নয়। তবুও ওই সকল ছায়াছবির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিছুটা হলেও ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। আমি একজন নৌ-কমান্ড মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওই সকল নির্মাতাকে স্যালুট ও অভিবাদন জানাই।
(চলবে)