শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস : বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র

আপডেট: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

কাজী মোহাম্মদ অনিক ইসলাম:


আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সায়াহ্নে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। জাতি যখন বিজয়ের খুব সন্নিকটে, সেই সময় তারা তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাঙালির প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, বরেণ্য শিল্পী, প্রতিথযশা সাহিত্যিক, নামজাদা সাংবাদিক, সুবিদিত চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞ আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে নির্বিচারে হত্যা করে।

যুদ্ধে জয়ী হলেও বাঙালি জাতি যেন আর কোনোদিন বিশ্বসভায় শিক্ষা, মননে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। খুনিদের মূল লক্ষ্য ছিল লড়াকু বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করলেও যেন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু, দুর্বল ও দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও নতুন রাষ্ট্রকে মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবীদেরকে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আলবদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুরের বধ্যভূমিসহ ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। রায়েরবাজার ও মিরপুর এ দুটি স্থান বর্তমানে বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত।

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন-অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডা. আবদুল আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান, এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ অনেকে।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, একাত্তরে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৬ জন শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহিদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু, তার এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে মেরে ফেলা।

স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে তৎকালীন সরকার। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ বেসরকারিভাবে গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’। এরপর গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’। কিন্তু তাঁর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিশনের আহ্বায়ক ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান যিনি ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। তরুণ এই চলচ্চিত্রকার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার রহস্য উদঘাটনের। তার সংগ্রহে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক অমূল্য প্রামাণ্যচিত্র ছিল। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হানের অন্তর্ধান আজও এক বিরাট রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো নয় মাস ধরে যে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছিল, ধারণা করা হয় এর মূল পরিকল্পনা ও নীল নকশা করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী। যদিও তিনি পরবর্তীতে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। ড. মুনতাসীর মামুন তার ‘সেই সব পাকিস্তানী’ বইতে লিখেছেন, “যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) রাও ফরমান আলীর একটি ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশের অনেক নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীর নামের তালিকা লেখা ছিল”।

শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলিম চৌধুরী এর কন্যা অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘বিচারহীনতার যে কষাঘাতে আমরা ছিলাম এবং পঁচাত্তরের পর বাবার খুনিদের মন্ত্রী হতে দেখেছি। আমার বাবার আত্মস্বীকৃত খুনী মাওলানা মান্নানকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে ১৪ ডিসেম্বর ফুল দিতে যেত তারা শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধে। বলত আমাদের বাবারা জাতীয় বীর অথচ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতো বাবার খুনিরা, কী হাস্যকর! কী পরিহাস!’

বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার। তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা জাতীয় অগ্রগতির সহায়ক। জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ প্রদানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে বিপুল অবদান রাখেন। কিন্তু, জাতির দুর্ভাগ্য, বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী পরিকল্পিতভাবে এ দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতির জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখি-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাঁদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জাতির এই গৌরবদীপ্ত সন্তানদের আত্মদান বৃথা যায়নি এবং চিরদিন পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাপাড়ের মানুষ তাদের আত্মত্যাগকে স্বীকার করবে গভীর কৃতজ্ঞতায়।

তথ্যসূত্র :
১। জেলা প্রশাসন, মেহেরপুর কর্তৃক প্রকাশিত ‘মুজিববর্ষে শতঘণ্টা মুজিবচর্চা’ গ্রন্থ
২। সেই সব পাকিস্তানি: ড. মুনতাসীর মামুন
৩। নিউজ উইক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন এর লেখা
৪। মুক্তিযুদ্ধে শত শহিদ বুদ্ধিজীবী: সুপা সাদিয়া
৫। বাংলাপিডিয়া
লেখক : সহকারী কমিশনার (ভূমি), শাহাজানপুর, বগুড়া।