জি আই সনদের সন্ধানে চাপাইনবাবগঞ্জ

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

সামসুল ইসলাম টুকু:সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় জিআই সনদ আদায়ের লড়াই বা হিড়িক পড়েছে এবং এ সংক্রান্ত খবরও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এমনকি বিবিসি থেকেও প্রচার হতে দেখা যায়। পাশাপাশি এই সনদ ছিনতাই, ফেরৎ এমন খবরও পত্র পত্রিকায় এসেছে। আবার এমন ঘটনাও আছে যারা জিআই সনদ পাওয়ার উপযুক্ত কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা, আবেদন ও সুপারিশের অভাবে জিআই সনদ পাচ্ছে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে সনদ প্রদানকারী সংস্থাকে যেমন কিছুটা সমস্যায় ফেলেছে তেমনি তাদের এ ব্যাপারে আরও খোলামেলা হওয়ার পথ করে দিয়েছে তথা পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এর মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করে আবেদনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ এবার বলেছেন শুধু আবেদন করলেই হবে না অন্য জেলার একই ধরনের পণ্যের তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করা হবে। জিআই সনদ হচ্ছে ভৌগলিক নির্দেশক বা যা কোনো পণ্য সামগ্রী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য সংস্কৃতি ইতিহাসকে বোঝায়। পাশাপাশি এগুলোর গুনগত মান বৈশিষ্ট প্রস্তুত প্রণালী খ্যাতি নিশ্চিত করে।

ইতোমধ্যে দেশের ২১টি পণ্য বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট ও ডিজাইন বিভাগ থেকে জি আই সনদ পেয়েছে এবং আরও ১৪ টি পণ্য সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। সনদপ্রাপ্ত ২১ টি পণ্যের মধ্যে ১৫ টির আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট পণ্যের সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান এবং ৬টি পণ্যের আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর জেলা প্রশাসক। এ তথ্য থেকে প্রমাণ হয় যে, জিআই সনদ পেতে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ও সুপারিশ প্রয়োজন হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে অংশ জি আই হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অসংখ্য সম্পদে সমৃদ্ধ একটি জেলা হওয়া সত্ত্বেও এবং বেশ কয়েকটি পণ্যের জি আই সনদ পাওয়ার পরিপূর্ণ যোগ্যতা থাকলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসকদের উল্লেখযোগ্য কোনো ভুমিকা দেখা যায়নি। ফলে কিছু পণ্যের সনদ অন্য জেলা নিয়ে গেছে। এর মধ্যে শিবগঞ্জের আদি চমচম। এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য কয়েকশো বছর আগের স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়, নরম। এই চমচম প্রচুর পরিমাণে জেলার বাইরে যায়। সোনামসজিদ দেখতে আসা পর্যটক ও আম মৌসুমে আসা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আম ব্যাপারীরা এই চমচম না নিয়ে যায় না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহারাজপুরের তৈরি তিলের খাজার ইতিহাস কমপক্ষে দুশো বছরের। মুচমুচে এই খাজার চাহিদা রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। শুধু তাই নয়, এই খাজা প্যাকেট হয়ে যায় পৃথিবীর বহু দেশে- যেখানে প্রবাসী বাঙালিরা থাকেন। নক্সিকাঁথা চাঁপাইনবাবগঞ্জের জি আই বহু পুরনো ঐতিহ্য। সর্বস্তরের নারীদের একটি অবসরকালীন কাজ। কাপড় আর বিভিন্ন রঙের সুতো দিয়ে মনোমুগদ্ধকর নক্সা তৈরি করা, দর্শনীয় শিল্প। নারীরা সংসারের কাজ সেরে বিকেলে দল বেঁধে নিজ নিজ গ্রামের কোনো গাছতলায় বা খোলা মাঠে বা কারো বাড়ির আঙিনায় কাঁথার ডালা আর সুচ সুতা নিয়ে হাজির হয়।

আপন মনে কাজ করছে আর পারিবারিক গল্পের সাথে নিপুণভাবে সুচের কাজ করছে। গত ৫০ বছর আগে থেকে কিছু এনজিও গ্রামীণ নারীদের সামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে এই নক্সি কাঁথা তৈরি করিয়ে নেয়। যা তারা চড়ামূল্যে ব্র্যাকসহ ঢাকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমন কয়েকটি দোকানও আছে। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা এখান থেকে পছন্দ মত নক্সি কাঁথা কেনেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জিআই সনদের জন্য আবেদন করা হয়নি। বরং জামালপুরের জেলা প্রশাসক আবেদন করে জিআই সনদ আদায় করেছেন। এই পণ্য ৩টি প্রতিষ্ঠানিক সহযোগিতার অভাবে পেটেন্ট বিভাগের কাছে জি আই তুলনামূলক বিচারেও স্থান করে নিতে পারেনি।

রেশম-বৃটিশ আমলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নীল চাষের পাশাপাশি রেশম চাষ হয়েছে। সেক্ষত্রে চাঁপাই নবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা সেই যুগ থেকেই রেশমের সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত। শুধু তাই নয়, দেশে মোট উৎপাদিত রেশম সুতার ৬০ শতাংশই ভোলাহাটে উৎপাদিত হয় এবং চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও লাহারপুরের তাঁতীদের বোনা রেশম শাড়ি ও থান পৃথিবী খ্যাত। এটা ইতিহাস স্বীকৃত। তথাপি রাজশাহী শহরে কিছু পাওয়ার লুম বসিয়ে রাজশাহী শিল্ক নামে জিআই সনদ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও চাঁপাই নবাবগঞ্জকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে সনদ প্রদানকারী সংস্থা সনদ প্রদানের পূর্বে খোঁজ নেয়নি যে এমন মানসম্মত দুই জি আই প্রকারের মিষ্টি অন্য জেলাতেও থাকতে পারে এবং রেশমের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্য কোথাও রয়েছে। যেমনভাবে বলা যায়, ঐতিহাসিকভাবে ফজলি আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের পণ্য হলেও সনদ দেওয়া হয়েছিল রাজশাহীকে।

ভাগ্য ভাল চাঁপাই নবাগঞ্জবাসী যথাসময়ে জানতে পেরে জেলাবাসীর পক্ষে কৃষি এসোসিয়েশন ওই সনদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তারপরেও শেষ পর্যন্ত রাজশাহীকে অর্ধেক অংশীদার করে রেখে দিয়েছে।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের আরও কিছু পণ্যের জিআই সনদ পেতে পারে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করা যায় যেমন- দমমিসরি (প্যাড়া),রসকদম, জিলাপি।

চাঁপাই নবাবগঞ্জের এই ৩ জাতের মিষ্টি অন্যান্য জেলার মিষ্টির চাইতে গুনগত মান ও স্বাদের দিক থেকে অনন্য, উন্নত ও রুচিসম্মত। সারাদেশে এগুলোর কদর আছে ঢাকার অফিসপাড়ায় এই ৩ জাতের মিষ্টির উপহার সর্বজনবিদিত। আর অন্ততপক্ষে দেড়শো বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। মনাকষার দমমিসরি বা প্যাড়া, জি আই পোস্তদানা সংবলিত রসকদম এবং স্পেশাল জিলাপি যা শুধু রোজার মাসেই তৈরি হয়। এ জাতীয় মিষ্টি অন্য জেলাতেও তৈরি হয় কিন্তু চাঁপাই নবাবগঞ্জের ধারে কাছে পৌঁছাতে পারবে না। এই ৩ জাতের মিষ্টির জিআই সনদের জন্য জেলা প্রশাসক ভূমিকা রাখতে পারেন।

কলাইয়ের রুটি : জি আই কলাইয়ের রুটিও চাঁপাইনবাবগঞ্জ একসাথে বাঁধা। কলাইয়ের আটা ও চালের আটার সমন্বয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৃহবধুদের হাতে পাকানো রুটির ইতিহাস ও ঐতিহ্য কয়েকশো বছরের পুরনো। এ রুটি পুষ্টিগুন ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর। এ রুটি খাওয়ার প্রচলন এখন জেলা ছাড়িয়ে রাজধানী ঢাকা সহ অন্যান্য জেলায় পৌছে গেছে। দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে কলাই রুটি তৈরির দোকান দেখা যায়। দিয়াড় অঞ্চলে এ রুটি ছাড়া নাস্তা হয় না।

কলাইয়ের আটা ও কুমড়ার বড়ি : জি আই কাঁচা কলাইএর আটা এবং চালকুমড়ার শাঁস মিশিয়ে অন্ততপক্ষে ২ ঘণ্টাব্যাপী হাত দিয়ে ফেনিয়ে সাদা না হওয়া এবং পানিতে না ভাঁসা পর্যন্ত তা উৎকৃষ্ট বড়ি হয় না। সেই বড়ি একটি ভিন্ন স্বাদযুক্ত লোভনীয় তরকারি বহুকাল ধরে চিহ্নিত। শীতের শেষে চাঁপাই নবাবগঞ্জের বাড়িতে বাড়িতে বড়ি করার ধুম পড়ে যায়। প্রায় ২৫/৩০ বছর আগে থেকে এই কলাইয়ের আটা ও বড়ি উড়োজাহাজে ভ্রমণ করে আমেরিকা কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়া পর্যন্ত গেছে। প্রবাসী চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারীরা বিদেশ যাওয়ার আগে তদের লাগেজে অতি যত্ন করে আটা ও বড়ি নিবেই। এখন ওইসব দেশের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার মলগুলোতে কলাই আটা ও বড়ি পাওয়া যায়।

চালের আটার লাড়ু : জি আই এটি অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর, রুচিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। বিশেষ করে প্রসব পরর্বতী নারীদের জন্য খুবই বলকারক ও ক্ষত নাড়ি শুকানোর জন্য মহৌষধ। এটি সব শ্রেণির মানুষ খেতে পারে। প্রথমে চাল খোলায় ভেজে তার সাথে পরিমাণমত গরম মসলা, সুঁট, গোলমরিচ, জৈত্রি মিশিয়ে জাতায় পিষে আটা করতে হয়। তারপরে পরিমাণমত কুসরের গুড় মিশিয়ে ঢেঁকিতে বা ওখলে কুটে একাকার হলে এবং মিশ্রণটা সামান্য গরম হলে সেগুলো হাত দিয়ে গোল করলে লাড়ু তৈরি হয়। কিছুক্ষণ পরে সেটা খুব শক্ত হয়। ২ বছর পর্যন্ত এর স্বাদ ও গন্ধ অপরিবর্তিত থাকে। আগের যুগে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেনি তখন কবিরাজগণ প্রসবকারিনি নারীদের জন্য এই আটার লাড়ু খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। কাঁচা নাড়ি শুকানোর জন্য এই লাড়ু সত্যি ধন্বন্তরি ছিল। আজও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারীরা এই লাড়ু তৈরি করেন সপরিবারে খাওয়ার জন্য এবং নবজাতক হবার পর শ্বশুর বাড়ি থেকে এই লাড়ু তৈরি করে পাঠানো হয় অথবা লাড়ূ তৈরি করার মালমশলা বউমার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষায় ব্যাভার বলা হয়।

লাক্ষা : জি আই এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একটি অতিরিক্ত এবং অর্থকরি কৃষি সম্পদ। দেশের শুধু মাত্র এই জেলাতেই কৃষক পর্যায়ে এর চাষ হয়। কুলের বাগানেই মূলত এর চাষ হয়। কারণ লাক্ষা পোকার জন্য উৎকৃষ্ট পোষক গাছ হচ্ছে কুল গাছ। এতে লাক্ষা পোকা ছেড়ে দিলেই লক্ষ লক্ষ পোকার জন্মদান সহ তাদের ছেড়ে দেওয়া লালাই হচ্ছে লাক্ষা। ঐতিহাসিকদের মতে ১৭৮৯ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ভারতের ছোট নাগপুর, ঝাড়খন্ড, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে লাক্ষার চাষ শুরু হয়। ১৮১৯ সালের দিকে এর চাষ গাঙ্গেয় অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ১৯০০ সালের দিকে এটি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা সহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিনোদপুর, শ্যামপুর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় লাক্ষা চাষ করে বিনোদপুরের কিছু মানুষ অর্থশালী হয়েছিল তাই তাকে সোনার বিনোদপুর বলা হতো।

১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে লাক্ষা বীজ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয় .১৯৮৫ সালে এই কেন্দ্রটি কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারে স্থানান্তর করা হয় এবং ১৯৯০ সালে সেখানে লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

এদিকে লাক্ষা চাষ ও স্থানান্তরিত হয়ে নাচোল উপজেলার মাক্তাপুর ও কাজলা গ্রামে। এ দুটি গ্রামকে লাক্ষা গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। লাক্ষা চাষীরা যথেষ্ট উৎসাহের সাথে চাষ করলেও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ চাঁপাইনবাবগঞ্জে লাক্ষার উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে ৩০ থেকে ৬০ দশকে। এই কৃষি পণ্যটি আরও বিকশিত হতে পারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে এবং দেশে এর বিপুল চাহিদার কথা বিচার করেই এই পণ্যটি জি আই সনদ পেতে পারে।

গোপালভোগ আম : এ আমটি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার বাইরে উৎপাদন হয় বলে জানা যায় না। এটি একটি উৎকৃষ্ট মানের আম। যা ল্যাংড়া ও খিরসাপাতের সাথে তুল্য। ইতোপুর্বে অন্যান্য আমের সাথে এটির জি আই সনদের জন্য আবেদন করার কথা ছিল। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঁশা পিতল শিল্প, নক্সি কাঁথা (যা বিদেশে যায়) ধনে পাতা প্রচুর পরিমাণে ঢাকা যায়Ñ প্রভৃতি পণ্যের জিআই সনদ পাওয়ার হকদার চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী। প্রয়োজনে এগুলোর ইতিহাস ঐতিহ্য দেওয়া যেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক