ভাষার প্রশ্নে আমরা এক হবো বিভক্ত নয়

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির

দৈনিক কাগজগুলোতে কথার মালা। সব কথা জাতিকে সুদৃঢ় পদে দাঁড়াবার ইচ্ছা অপেক্ষা ব্যক্তিগত ভাবে বেড়ে ওঠার গরিমা। না এখান থেকেই জাতীয় ইচ্ছার প্রতিফলন হবে, সেটা অস্বীকার করা যায় না। তবে কতদিনে। আমাদের প্রতীক্ষার কাল সমাপ্ত হতে চললো। যদিও শেষ মুঘল সম্রাট মরমি কবি গালিবের বন্ধু বাহাদুর শাহ জাফর দুঃখ করে বলেছিলেন, প্রাপ্তি আর প্রতীক্ষা আকাক্সক্ষায় তাঁর জীবন কেটে গেছে, সুপ্রভাত আসেনি। সে ইতিহাস আমরা অনেকেই জানি। রাত্রিশেষের কবি আহসান হাবীব ‘এইমন Ñএ মৃত্তিকা’ কবিতায় দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেছিলেন, জীবন থেকে অশেষ আশার দিন পলাতক হলেও ‘আজো এ হৃদয় দিনের আশাতে দুঃসহ দিন যাপে।’ আমরা খেটে খাওয়া মানুষ কল্পনার ফানুস প্রলুব্ধ করলেও প্রতিদিন অন্ন জোটাবার জন্য বেসামাল হতে হয়।

নয় শ্রম আমরা দিব; কিন্তু মূল্য বঞ্চিত যেন না হই। আমরা উচ্চবাচ্য করাদের চিনি, তবুও মাঝে মাঝে ফাঁদে পড়তে হয়। আর যেন ফাঁদে না পড়ি। সেটাই হবে গণতন্ত্রের মূল প্রাপ্তি। নিজে খাব, পাশের মানুষ অভুক্ত থাকবে, তা গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের আসল রূপ হলো যোগ্যতা ও অধিকার সম্পর্কে সদা সচেতন থাকা। আমরা তা চাই নাÑ সবটাই আমার, যতক্ষণ ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতা দিয়ে অশুভ ইচ্ছার দমন করতে পারলেই জনগণের মুক্তি। ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ আমরা আর প্রাণ বিসর্জন দিতে চাই না। আমাদের ভাবনার শেষ আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন: ‘আমি কেবলই স্বপন করেছি বপণ বাতাসেÑতাই আকাশ কুসুম করিনু চয়ন হুতাসে॥’

মধ্য বয়সের এ হুতাস তাঁর থাকেনি। তিনি মানুষের মাঝে আশ্রয় জেঁচেছেন। আমরা মানুষের অসহায় মুখের দিকে চেয়ে মানুষের জন্য মুক্তি খুঁজবো। ভাষার মাঝে তাই হোক আমাদের শেষ প্রার্থনা। ধর্ম রক্ষা কিংবা সিংহাসন লাভÑ কোনটি ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো না। ছিলো আমাদের মুখের ভাষা দিয়ে জ্ঞানের সাগর পাড়ি দিব। জানিয়ে দিব পৃথিবীর সব ধ্বনি উচ্চারণ এবং ধারণের ক্ষমতা কী অপরূপ ভাবে গ্রথিত আছে আমাদের শ্যামল কোমল ভাষার অঙ্গে। আরবি এবং ইংরেজি ভাষার প্রতাপ যতই থাক না কেন, সব ধ্বনি এরা নিজের অঙ্গে মিশিয়ে নিতে পারে না। দুঃখের বিষয় সে গৌরব আমরা বিশ্ববাসির কানে পৌঁছে দিতে পারলাম না। নিজেদের সংকীর্ণতার জন্য। আজও একুশে ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবী চাদর গায়ে অনুষ্ঠানে যাই, আর বাড়ি গিয়ে বিজাতীয় ভাষায় প্রভুভক্তের সাথে কথা বলি। এই দ্বি-চারণ শোভন নয়Ñ না ঘরে, না বাইরে।
এসব বদ খাসলত দূর করতে না পারলে মাতৃভাষা যে অভিশাপ দিতে থাকবে সেখান থেকে আমাদের রেহাই হবে কী!

আমরা চঞ্চল হয়ে ঘুরছি। নতুন নতুন পদ সৃষ্টি ফন্দি আঁটছি। অনেক সময় পেয়েও যাচ্ছি। গ্রামে গঞ্জে মাতৃভাষার মহিমা কীর্তন করতে গিয়ে সব খেই হারিয়ে ফেলছি। তা দিয়ে মাতৃভাষার উন্নয়ন হয় না। সত্যিকার ভাষাপ্রেমীদের সমন্বয়ে ভাষার প্রতি দরদ দেখাতে পারলে আমরা দাঁড়াতে পারবো। না হলে আবার ‘৫২ এর প্রতীক্ষা নিষ্ফল হবে।
ভাষার প্রশ্ন তুলে আমরা দেশ পেয়েছি। সেই দেশের মর্যাদা বাড়াতে আমাদের সুদৃঢ় পদে দাঁড়াতে হবে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ