ভাষার মুক্তিতেই আমাদের মুক্তি

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির: ভাষার কার কথা লেখবো। নিজের কথা! না তা মোটেও মুখর নয়। রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে বলি ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবেনা’- জানাই শুরু করিনি, তা ফুরাবার প্রশ্ন্ই ওঠে না। তাই সজ্জনদের খুঁজি। তাঁদের মাধ্যমে যদি দেশ ও জাতিকে কিছু দেয়া যায়।

ভাষার হাজার বছরের ইতিহাসে কয়েক হাজার মনস্বীর জন্ম দিয়েছে বাংলার মাটি। তাদের কজনকে আমরা মনে রেখেছি আর রাখলেও গুরুত্ব দেইনি। আমাদের স্বভাব ‘ঘরের ঠাকুর ছেড়ে’ পরদেশের কুকুর লেহন করা।
না, যার যা মূল্য দিতে হবে তাই বলে অপাত্রকে ‘ঊর্ধে তুলিয়া ধরিয়া ধূলায় নামিল শশি’ হবে তা মোটেও শোভন নয়- না জীবনে, না প্রকৃতিতে।

১৮৯৭ যাঁর জন্ম কিশোরগঞ্জের নরম মাটিতে ২৩ নভেম্বর অর তিরোধান শতবর্ষ পরে ১৯৯৯, ১ আগস্ট, অক্সফোর্ডে– পরবাসে। তাঁর আত্মজীবনী ‘অ্যান অটো বাইয়োগ্রাফি অফ অ্যান আন নোন ইন্ডিয়ান’ পড়লে তাঁর ক্ষোভ ও দুখের কথা জানা যাবে। বিষয়টি তাঁর নিজস্ব হলেও আমরা তাঁর সাথে কখনো কখনো শরীক না হয়ে পারিনা। তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছেড়ে কথা বলেননি। আমাদের অতবড় সাহস কিংবা পাঠের পরিধি বিস্তৃত নয় যে অমন কথা উচ্চারণ করবো। নীরদচন্দ্র চৌধুরী সংক্ষেপে লেখতেন এন.সি. চৌধুরী। এখ>ন তিনি আলোচনার ভেতর থেকে প্রায় হারিয়ে গেছেন। আমরা তাঁকে নিয়ে কথা বলবোনা। সামনে ভাষা আন্দোলনের অমর দিন কড়া নাড়ছে। সে বিষয়টি একটু চোখ বুলিয়ে নেব। ১৯৪০ সাল থেকে ভাষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশ স্বাধীন হবে অচিরে।

রাষ্ট্রভাষা কী হবে তার প্রশ্ন ছিলো অগ্রগামীদের মনে। নানা মুনির নানামতের মধ্যে আমাদের নাড়ির ভাষা বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার মতামত প্রতিপালিত হয়। জোর করে নয় গণতান্ত্রিক অধিকারে। পশ্চিমারা তা মানতে রাজি হয়নি। অনেকের ধারণা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা ব্যক্তিবর্গ প্রতিবন্ধক হয়েছে। এটা সঠিক নয়। আমার শিক্ষক মাওলানা তাহের উদ্দিন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস করে এসে প্রথম থেকেই তিনি বাংলা মাধ্যমে পাঠদান। কারণ ধর্ম শিক্ষার দরবারে আরবি-ফারসি-উর্দু ছাড়া অন্য ভাষার প্রশ্রয় ছিলোনা। আমার পিতা মাওলানা হিশামুদ্দীন মাতৃভাষার প্রতি এমনি অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন যে বাংলায় ধর্মীয় জ্ঞান দানের জন্য ‘মুসলিম জাহান’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করতেন এবং জমিজমার ভাগাভাগির ধর্মীয় নীতিকথাগুলো তিনি বাংলা ভাষায় রূপ দিয়েছিলেন। বইখানার নাম ছিলো ‘মিরাসুল মুসলেমিন’ অর্থাৎ ‘মুসলমানদের সম্পত্তি’। এঁদের নাম ভাষা আন্দোলনের পুস্তকে ভুলেও কেউ লেখেনি।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন) ভাষার দাবিতে রাজপথ রক্তাক্ত হলো। সেই রক্তের ধারা একাত্তরের দিনগুলিতে দেশময় ছড়িয়ে গেল। আমরা রক্তের বিনিময়ে একটা সার্বভৌম দেশ পেলাম। ভাষা তার মর্যাদা পায়নি। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিলো সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার। তা কার্যকর করা হয়েছে কি? বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাদের হত্যার পর ভাষার কণ্ঠরোধ করা হলো। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেয়ে গেল। কিছু ব্যাংকও খোলা হলো বাংলা ভাষা বর্জিত। সেই সংগে চমক লাগিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সয়লাব। সেখানে মাতৃভাষার ছোঁয়া নেই। বাংলার মানুষ যেন পাথারে পড়ে গেছে। ইংলিশ মিডিয়ামে অ লেবেল পাস করে বিদেশ খোঁজ করতে হয়। তাদের পরিণতি নিয়ে কেউ ভাবেনা।

মাতৃভাষার প্রতি, দেশের উন্নয়নের ভাবনায় এবং বঙ্গবন্ধুর সর্বস্ব ত্যাগের দিকে আমরা তাকাইনা। ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ আমাদের লক্ষ্য। এই মৃত লক্ষ্য আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। আমাদের উত্তরসুরীরা তখন বলবে বিভ্রান্ত বাঙালি। আমরা তা হতে চাইনা। এমনটি হতে চায়নি চীন কিংবা জাপান-ফ্রান্স। এরা ঈর্ষনীয় সাবলস্বী। আমরা আজও ‘ওল ছেলা’ চেহারার অনুসারী। এখান থেকে আমাদের অবশ্যই মুক্ত হতে হবে। বাঙালি প্রকৃত মুক্ত হবে তখন।

লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ