মনুষ্যত্ব দাঁড়াবে কোথায়

আপডেট: জানুয়ারি ১৮, ২০২৪, ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

গোলাম কবির


রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের দুটি বিষয়ের প্রতি অধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন নির্ভেজাল বাঙালি সন্তান। সংস্কৃত তিনি ব্যাপক অধ্যয়ন করেন। ইংরেজিও কম জানতেন না। এমনকি প্রচলিত আরবি ভাষার প্রতিও তাঁর অনুরাগ ছিলো। মোটকথা জীবন সঞ্চালনের জন্য তাঁর জানার অবধি পরিমাপ করা দ্বিশতবর্ষ পরে সহজ না হলেও অনুমান করা কঠিন নয়।

১৩০২ বঙ্গাব্দের ১৩ই শ্রাবণ অপরাহ্নে বিদ্যাসাগর স্মরণার্থ সভার সাংবৎসরিক অধিবেশনে এমারন্ড থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে পঠিত সভায় ‘বিদ্যাসাগর রচিত’ রচনার শেষে রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ ও তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব;’ আমরা এই মনুষ্যত্বের সন্ধান করতে চাই আমাদের বর্তমান জনগোষ্ঠীতে।

মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টি তৈরি না হলে কোনো ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ কঠিন। ধর্ম মানুষকে সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালনের একেকটি পন্থা। তাই বলে সেইটি অনন্য নয়। কোনো ব্যক্তি মানব কল্যাণে নিবেদিত জীবন পন্থা অবলম্বনে পরিচালিত হয়ে অন্যের দিক নির্দেশনায় নিবেদিত হলে তাকে অবশ্যই শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা বোধকরি অন্যায় নয়। মানবচরিত্রে এই উপাদান যার যত বেশি তাঁকেই বলা হয় মনুষ্যত্ব। বিদ্যাসাগর কোনো ধর্মের নিরিখে নিজে পরিচালিত হবার বাধ্যবাধকতা তৈরি করেন নি। মনুষ্যত্বই ছিলো তাঁর চরিত্রের অতুলনীয় ভূষণ।

আমাদের চারপাশে চোখ মেলে দেখি প্রবল মনুষ্যত্ব নিয়ে কতজন আমাদের আকৃষ্ট করেছেন। আমরা ব্যক্তিকে দেখি, তাঁর কর্মসাধনা আমাদের ক্ষণিক মুগ্ধ করে। তাই বলে নিজেদের গঠন করতে আমরা পরান্মুখ হবো কেন! আমাদের সমাজে এই যে নৈরাজ্য। সুষ্ঠু সমাজ গড়ার সাধনা যাঁরা করে গেছেন, তাঁদের আমরা ভুলতে বসেছি নিজেদের দুর্বলতা এবং স্বার্থমগ্ন মানুষের প্ররোচনায়। আমরা একবার নিজেদের গভীরে দৃষ্টি মেলি, দেখবো কত নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমিক অবহেলায় অনাদরে চলে গেছেন আমরা তাদের তুলে আনিনি। আমাদের রবীন্দ্রনাথ নেই যিনি সেই মনীষীদের কুড়িয়ে এনে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। আমরা এমনি অকিঞ্চিৎকর যে সমাজে আমাদের কথা কোথাও উচ্চস্বরে বাজে না। তবুও বলতে হয় তাই বলা।

এই সুযোগে এক শিক্ষকের মনুষ্যত্বকে স্মরণ করে শিক্ষার ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করি। তিনি আমরা প্রথম চার ভাই-বোনের গৃহশিক্ষক ছিলেন। তিনি প্রাইমারি পাস এবং গুরু ট্রেনিং দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করতেন। আমার আব্বা প্রবর্তিত বিদ্যালয়ে প্রথম শিক্ষক। তিনি আমাদের চার ভাই বোনকে পড়াতেন। মানুষটি ছিলেন কঠিন-কোমল। আমি তাঁর নির্দেশ মানার উপযুক্ত না হলেও এক পাটিতে বসতাম। তিনি সস্নেহে আমাকে আশ্রয় দিতেন। বাঙালির প্রতি এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিলো।

পরাধীন বাঙালির স্বাধীনতার দ্বার উন্মুক্ত হবার পথে পাকিস্তানি আর এদেশের দোসররা যে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য রাখতেন। তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাক্য উচ্চারণ ছিলো মহা অপরাধ। তিনি ভয়ে ছিলেন, পাকিস্তানি অভিমুখীরা হয়তো অবৈধ পিতাদের প্ররোচিত করে তাঁকে অযাচিত মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিবে। তাই গৃহকোণে আত্মগোপনে থেকে বাঁশের আড়ায় দড়ি বেঁধে আত্মত্যাগ করেন। ১৬ই ডিসেম্বরের মাত্র কদিন আগে। তখন মুখে মুখে মানুষ আত্মহত্যা মহাপাপকে মহাপুণ্য বলে প্রশ্বস্তি করেছিলো। আজ তিনি বিস্মৃতির অন্তরালে। আমারও বিদায়ের সময় সমাগত। তাই এই মহান শিক্ষককে স্মরণ করে শিক্ষার ঋণ শোধ করতে চাই। তিনি মকবুল হোসেন।

তাঁর স্মরণ শক্তির কথা মনে হলে বিস্ময়ে হতবাক হই। তার প্রিয় বিষয় ছিলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। সেখান থেকেই আমার বাংলা পড়ার আগ্রহ। পড়েছি। চাকরি করেছি। সেই ভাষার সুবাদে; কিন্তু তেমন মেধার অভাবে স্মরণীয় হতে পারিনি। তাই বলে স্মরণ্যদের উপস্থাপন না করলে মহাকাল আমাকে ক্ষমা করবে কেন!

মকবুল হোসেনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সংলগ্ন নামোশংকরবাটি গ্রামের তেলিপাড়ায়। দরিদ্র বলে বেশি লেখাপড়ার সুযোগ তাঁর হয়নি। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেয়ে না খেয়ে গেছেন এবং শিক্ষার হাতে খড়ি সেখান থেকেই লাভ করে দিনাতিপাত করার জন্য আমার আব্বা প্রবর্তিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন।

তিনি কখনো বই হাতে নিয়ে পড়ান নি। সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত বিষয় তাঁর মুখস্থ। তিনি অনায়াসে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত বই ছাড়া ক্লাস নিতেন। সবার মাঝে তা ছিলো আলোচনার বিষয়। তাঁকে অনুসরণ করে আমিও মাঝে মাঝে বই ছাড়া ক্লাস নিতাম। ‘সে যে আজ হলো কতকাল’ তিনি চলে গেছেন।

তাঁর ছেলেরা কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরাও তার জন্য কিছু করিনি। নির্বাচনে যারা আজ মাঠ-ময়দান সয়লাভ করছেন, জানিনা জাতির উন্নয়নে তারা কতখানি তৎপর। আমরা মনুষ্যত্বহীন ব্যক্তিদের পরিত্যাগ করে মনুষ্যত্বপূর্ণ মানুষকে দেশ চালনার ভার অর্পণ করতে পারলে হয়তো বঙ্গবন্ধু কথিত বাংলাদেশ সোনার দেশে রূপান্তর হবে। দেশে মনুষ্যত্ব দাঁড়াবার স্থান পাবে।
লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ