রবীন্দ্রনাথ সরেন : আদিবাসী অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর

আপডেট: জানুয়ারি ১৬, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

মিথুশিলাক মুরমু


জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি বরীন্দ্রনাথ সরেন ১৩ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে নিজ বাসভবনে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। মি. সরেন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর দারকাল সরেন ও সুমি টুডু দম্পত্তির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শিক্ষা জীবনে তিনি বারকোণা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, হাবড়া উচ্চ বিদ্যালয়, পাবর্তীপুর, দিনাজপুর থেকে মাধ্যমিক ও দিনাজপুর সঙ্গীত কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রাজশাহীর শাহ্ মখদুম কলেজ থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। প্রায় ৬৬ বছর জীবনকালের ৩১ বছরই আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্মুখ সারিতেই সরব ছিলেন।

উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জেলা শহর, বিভাগীয় ও রাজধানীর রাজপথকেও কাঁপিয়েছে; কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার, জাতীয় প্রেস ক্লাব, সিরডাপ, ডেইলি স্টার কিংবা ওয়াইডব্লিউসিএ হলরুম সর্বত্রই ছিলো তার বিচরণ। আদিবাসীদের ৯ দফা দাবি দাওয়া ফেরি করে বেড়িয়েছেন, অন্যতম দাবি ছিলো- ‘আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাংবিধানিক স্বীকৃতি অর্থাৎ আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে ঠিকই আদিবাসীদের ঠাঁই হয়েছে তবে ভিন্ন পরিচয়ে, পরিচিতিতে। সংবিধানে আদিবাসী শব্দটিকে পরিহার করে যুক্ত করা হলো- উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ইত্যাদি। যৌক্তিকতা সঙ্গতভাবেই অনুমিত হয় যে, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পুনঃপুনঃ দাবি উত্থিতের প্রেক্ষিতে এবং সমমনা সংগঠনসমূহের যৌথ প্রচেষ্টায় দেশের শাসনতন্ত্রে আদিবাসীদের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ অক্টোবর জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ৫ম জাতীয় সম্মেলনে পুনর্বার সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ সরেন। মৃত্যুর ঠিক ৩ মাস পূর্বের সম্মেলনে হৃদয়ের কথাটিই উৎসারিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। আদিবাসীদের ওপর ‘দিকুর’ হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ভূমি জবরদখলসহ অন্যায় অত্যাচারের বিচার পাওয়া যায় না।’ এ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তার প্রিয় সংগঠন ‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদ’-এর তিন দশক পূর্তিতে সহাস্য উচ্চারণ করেছেন, ‘আদিবাসীদের জীবন যেন প্রতিশ্রুতি আর প্রতারণার জীবন। একের পর এক সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু আদিবাসীদের বঞ্চনার অবসান হয় না। এখন পর্যন্ত আদিবাসীদের জীবনে স্বস্তি তো আসেই নি বরং শঙ্কা বেড়েছে।’

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এটা মোটেই সহজ কথা না। আমরা আমাদের ছেলেবেলা থেকেই উচ্ছেদ থেকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সব হারিয়ে আসছি। …যখন আদিবাসীরা অত্যাচারিত হচ্ছে, তখন ৯৩ সালের দিকে আমরা নিজেদের সংগঠিত করি কারণ তার সে সময় অত্যাচারিত হয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।’ কঠিন সত্য কথা হচ্ছেÑ আজ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের স্থানচ্যুতকে ঠেকানো যায়নি। আদিবাসীরা দল-মত-নির্বিশেষে, ক্ষমতাসীন কিংবা রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রতিনিয়তই নানান ছল ছাতুরী, কৌশলের ফাঁদে পড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রাতের অন্ধকারে পাড়ি জমাচ্ছে নিরাপদ পোতাশ্রয়ে।

অন্তত এটুকু আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ সরেন কিংবা ‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদ’ আদিবাসীদের দুঃখ, দুদর্শা, অভাব-অভিযোগ, চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির কথাগুলো স্থানীয় প্রশাসন থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলো। আর এটির জন্যে কখানো ক্ষমতাসীন দলের চোখ রাঙানি, হুমকি ও রোষানলে পড়তে হয়েছে।

আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনে সর্বদা উদ্যোগী রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি’ একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে সমগ্র উত্তরবঙ্গে চষে বেড়িয়েছেন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁর ভীমপুর আলফ্রেড সরেন হত্যা, ফুলবাড়ি কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলন থেকে হালের বাগদা ফার্ম, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা উচ্ছেদের প্রবল স্রোতেও ঠাঁই দাঁড়িয়েছিলেন। আদিবাসীদের কান্না শোনার মনোভাব জাগ্রত করতেই সাংবাদিক সম্মেলন, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, কর্মশালায় তিনি ছিলেন বেশ সক্রিয় ও সজাগ।

প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ সরেন-এর দু’একটি প্রবন্ধ পড়েছি অর্থাৎ অধিকার আদায়ের দাবি-দাওয়াগুলোকে আরো জোরালো ও গণমানুষের হৃদয়ে সংগ্রোথিত করতেই কলমও হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যৌথভাবে সম্পাদনায় বেরিয়েছেÑ ‘জরিপ থেকে বয়ান’। আদিবাসীদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও থেমে ছিলেন না; কাপেং ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান চেয়ারে আসীন হয়ে আদিবাসীদের প্রতি অবমাননা, বৈষম্য, অধিকার বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর সর্বাংশে চেষ্টা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ সরেন ব্যক্তি জীবনে কৃষিকাজের পাশাপাশি আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের নেশা রক্তের সাথে মিশে গিয়েছিলো। বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির নেতা ছিলেন। সীমিত অর্থ-বিত্তের মধ্যে থেকেও স্বপ্ন সারথী হয়েছেন আদিবাসীদের। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁর আঘোর নিয়ামতপুরে প্রথম সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব স্মৃতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অত্র অঞ্চলে আদিবাসী সংগ্রাম গাঁথা তুলে ধরেন। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁর মহাদেবপুরের নাটশালে তিনিই প্রথম কারাম উৎসব শুরু করেন যা অদ্যাবধি সচল রয়েছে। নাটশালের পরেই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও ছড়িয়ে পড়েছে। দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় তেভাগা চত্বরে সিধু-কানু’র ম্যুরাল নির্মাণেও অগ্রণী ভূমিকা স্বাক্ষর রেখেছেন।

আদিবাসীদের নিখাদ ও নিরেট সত্য কথা তুলে ধরার লক্ষ্যেই আমন্ত্রিত হয়েছিলেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সভাতে। একদা উপলব্ধি থেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনাজপুর ৬ সংসদীয় আসন (নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, হাকিমপুর, ঘোড়াঘাট) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। পরাজিত হয়েছেন কিন্তু আন্দোলনের চেতনা, আদিবাসীদের অব্যক্ত কথাগুলো নির্ভিক চিত্তে, সাবলীল কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন।

জীবন সায়হ্নে শারীরিকভাবে যেমন দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, অনুরূপভাবে সাংগঠনিক তৎপরতাতেও সীমিত হয়ে পড়েছিলেন। নিজ হাতে গড়া ‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদ’ বিভক্তিতে খুবই মর্মাহত হয়েছেন। সাংগঠনিক অপতৎপরতা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আদিবাসী সভাপতিকে অব্যাহতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচন করার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেছিলেন, ‘সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির অনুমতি ছাড়া এই সভা কে আহবান করেছিলেন? সভায় কারা উপস্থিত ছিলেন? এই ধরনের ১টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সারাদেশের কমিটিগুলোকে আহবান করা হয়েছিল কিনা? সভাপতির অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত কি নেয়া যায়?

নূন্যতম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সাংগঠনিক নীতি মানলে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়।’ ক্ষুব্ধতার সাথেই বলেছিলেন, ‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদকে কোনো ব্যক্তির পকেট সংগঠনে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। আদিবাসীরা যখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত তখন কিছু ব্যক্তির আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য আদিবাসী পরিষদকে ব্যবহত হতে দেয়া যায় না।…আসলে এসব কিছুই হচ্ছে ভূমি দখল ও ভোট দখলের ষড়যন্ত্রের অংশ। আদিবাসীদেরকে বিভক্ত করে বিতাড়িত করার কৌশলের অংশ মাত্র।’ রবীন্দ্রনাথ সরেন জীবনকালেই দেখেছেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের বিভক্তি; হয়তো অকাল প্রয়াণ না হলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সংগঠনকে দ্বিখণ্ডিত হতে দিতেন না।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কিংবা রবীন্দ্রনাথ সরেন সবচেয়ে বেশি বির্তকের জন্ম দিয়েছিলেন সাঁওতালি ভাষায় প্রাক্ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ী বর্ষাপাড়ায় সাঁওতালি বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। মাধ্যম ছিলো সাঁওতালি ভাষায় বাংলা বর্ণমালায়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিয়েছিলো। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে সরকার ৬টি আদিবাসী (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, উরাঁও) মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; একমাত্র সাঁওতাল ব্যতিত বাকী ভাষাগুলোতে পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়েছে।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদ তথা বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ সরেন দাবি তোলেন এটি হতে হবে বাংলা বর্ণমালায়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন দাবি করেন পাঠ্যপুস্তক হবে অলচিকি বর্ণমালায়। উল্লেখ্য যে, মানিক সরেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন-এর পুত্র সন্তান। অপরদিকে দেশের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হবে সাঁওতালি রোমান বর্ণমালায়। আদিবাসী সাঁওতালদের বর্ণমালা বিতর্কের গ্যাড়াকলে বঞ্চিত হচ্ছে সাঁওতাল শিশুরা মাতৃভাষায় পাঠদান থেকে। যুগোত্তীর্ণের পরও এই অমীমাংসিত বিষয়টি দ্রুত সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন রবীন্দ্রনাথ সরেন-এর মৃত্যুতে শোকান্বিত হয়েছে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্মরণ করেছেÑ‘আদিবাসী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষসহ দেশের প্রান্তিক মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমৃত্যু লড়াই করেছেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। এই মানুষটির ত্যাগ চির অম্লান হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুতে সংখ্যালঘু আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ের অপূরণীয় শূন্যতা নেমে এসেছে। তার শূন্যতা এই জনগোষ্ঠীর লড়াইয়ের বিদ্যমান থাকবে।’ রবীন্দ্রনাথ সরেন চলে গেলেন, রেখে গেলেন আদর্শ। দোষে গুণেই মানুষ, আসুন রবীন্দ্রনাথ সরেন-এর অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বরকে ধারণ করি।
লেখক: সংবাদকর্মি