একুশের চেতনা এক অবিনাশী শক্তির নাম

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ


মো. আব্দুর রাজ্জাক

ক. শুরুকথা :
‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতেরই রক্ত।
…প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।’

একুশের উপলক্ষে সমকালীন বাংলা ভাষার প্রধান কবি আল মাহমুদের কবিতার মতোই আবেগপ্লাবন বয়ে যাচ্ছে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয় অলিন্দে, ধমণীতে। মাতৃভাষার জন্য জীবনদানের নজিরবিহীন আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল ২১ ফেব্রুয়ারি সত্যি সত্যিই অবিনাশী, অম্লান ও অক্ষয়। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেরুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।’ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বেদনার কথা মনে পড়ে, অন্যদিকে তেমনি মনে জাগে বিপ্লবের বাণী। একুশ আমাদের প্রাণ, একুশের আমাদের অহংকার। রক্তরাঙা, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অমর একুশে ফেরুয়ারি। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জনগণের মধ্যে এক নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং বাঙালিদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভের আন্দোলন দুর্বার করে তোলে। জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, “বাহান্ন-এর ২১ শে ফেরুয়ারী ছিল বাংলাদেশের প্রথম গণ-চেতনার সুসংগঠিত বহিঃপ্রকাশ এবং পরবর্তীকালে শাসকচক্রের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।”

খ. পটভূমি:
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান হয় দুটো অংশ নিয়ে-একটি পূর্ব পাকিস্তান আর অপরটি পাকিস্তান। বাংলা ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা। এ কারণে বিভিন্ন পণ্ডিত, একুশের বুদ্ধিজীবীগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ দাবির সমর্থনে দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। এ লক্ষ্যে পূর্ব বাংলায় প্রচার অভিযান চলে, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেরুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব করেন। তৎকালীন সরকার প্রধান লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্রসমাজ এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৬ ফেরুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। নতুন করে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এবং এর উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করা হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলায় সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করেন। সেদিন সমবেত জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। এরপর ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক বিদ্রোহ, আর গণজাগরণ দেখা দেয় বাংলার ঘরে ঘরে। অবশ্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুতে এ আন্দোলন কিছুদিনের জন্য হলেও থিতিয়ে পড়ে।

গ. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে একুশের:
১৯৫২-র ফেব্রুয়ারিতে রক্তাক্ষরে রচিত হয়েছিল এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসে যা একটি বিরল ঘটনা। এ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো সাধারণ সম্মেলনে বাংলাদেশ কর্তৃক পেশকৃত ও ২৮টি দেশের সমর্থিত খসড়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইউনেস্কোর মহাসচিব কইচিরো মাতসুরা এক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্যারিসের সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২০০০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বর মানুষের মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। এ দিবসটি পালিত হবে ততদিন বিশ্বব্যাপী বাংলার নাম, বাঙালিদের নাম উচ্চারিত হবে স্বাভাবিকভাবেই।

ঘ. যেভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেল:
কানাডা প্রবাসী কতিপয় উদ্যমী বাঙালির সংগঠন Mother Tongue Lovers Association UNESCO- এর সাধারণ সম্মেলনে একুশের ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি জানায়। তাছাড়া UNESCO সেক্রেটারিকে এদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করা হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রগুলো ইতিবাচক সাড়া দেবার পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত UNESCO সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রী একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেন। UNESCO-এর ১৯১টি সদস্যরাষ্ট্রের সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হয়। এরপর নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত করা হয়।

ঙ. ’৫২এর ঐতিহাসিক আন্দোলন:
১৯৫২ সালে একুশের বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত হয় নতুন পরিস্থিতি। ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে এক প্রতিনিধি সভায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং ব্যাপক আন্দোলনের প্রস্তুতি গড়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন। স্থির হয় ওই দিন পরিষদ ঘেরাও করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পাস করানো হবে। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পরের দিন ভোরে মুক্তিকামী ছাত্র ও জনতা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হয়। ঢাকার রাজপথ সেদিন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতার মিছিলের ধ্বনিতে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’- এই দীপ্ত স্লোগানে উচ্চকিত হয়ে ওঠে দেশের মানুষ, আপামর জনতা। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বাঙালির মায়ের ভাষাকে স্তব্ধ করার হীন উদ্দেশ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু তা লক্ষ জনতার বাধভাঙ্গা মিছিলের স্রোতকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। এক পর্যায়ে পুলিশ মিছিলের ওপর নির্দয়ভাবে গুলিবর্ষণ করে। ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত এবং আরও অনেকে। এভাবে রক্তে রঞ্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি অবশেষে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।