সম্মেলক গপ্প

আপডেট: ডিসেম্বর ৮, ২০২৩, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

নাজিম খোকন

অথচ গান হবে আড্ডা হবে কবিতা হবে,আরও হবে. . .
এইসব ভাবতে ভাবতে দেখলুম তারা সব উপ্রে যেমন-তেমন, ভেতরে রসুন…

পাঁঠার মাংস মৎস মোরগের ঠ্যাং চিবোচ্ছেন এক টেবিলে বসে খোসগল্পে মাতোয়ারা। বিড়ির মাথায় আগুন জ্বেলে নিজেদের মুখাগ্নি করছেন সবাই গোল হয়ে বসে। বিড়ির ভিত্রে মহাদেবের কল্কের ভষ্ম ঘূরে ঘুরে যাচ্ছে হাত বদলে, চৌকাঠের ওপারে উর্বসী রম্ভারা আড় নয়নে বাণ মারছেন Ñ আইসো হে মরদ নাগর ঠাণ্ডা করো দেহ, নুনছাল তুলে ফেলো বেমাক্কা, ধাক্কায়। শহর সরগরম করো তবেই না উৎসবের জৌলুস -জোয়ার। ভাটিতে বড্ড টান, উজানে নাও গো নাগর। খোলো স্যামপেন। দাদা, হচ্চেটা কি, এক্কেবারে মেরে দিলেন, তলানিটুকুও রেকে দিলেন না, পুরো ইলিশটাই গিলে নিলেন, অন্তত বিড়ির পোঁদটা দিতেন,- আরে বাবা পুরো প্যাকেটাই নাওনা, এটা তোমার, আজ্ঞে আপনারা দাদা ছত্তিই পারেন বটে, ইয়ে মানে আমাদের মতো মুরগির দিল্ না, হেঁ হেঁ জেঁ…। -মুখপোড়া কঁচু খা।

মনে মনে ইস্টবেঙ্গল -মোহন বাগানের লড়াই। চাঁদু মনে মনে যতোই গাল দাওনা, ঝেড়ে দিলে ঠিকমতো পুরো প্যাকেট, ইহারে কহে…। কেলো কার্তিকের ঠাম্মাও আজ কোমর বেকিয়ে ঠ্যাং উজিয়ে নাচছেন ধেই ধেই, কার্তিকের কাকা বা জেঠু যাই হোকনা কেনো, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তোর কিন্তু পা ফোলা, হাঁটুতে ব্যথা, পরে কিন্তু ঘাড়ে নিতে পারবোনা আগেই ব’লে দিলাম। সব শিয়াল পণ্ডিতেরা এক সঙ্গে হুক্কাহুয়া স্বরে সমর্থন জানালো। ওপারের রৌদ্দুর রায় এলে ভালো হতো। খিস্তি খেউড়ের সাথে মূল্যাবান তত্ত্বকথা, তার মতো মজলিসি গোলালাপ ক’জন পারে, আসর মাতে, মাতায় একাই সে। অবশ্য সাথে বাঙলা আর শ্রীশ্রী ওঁম শীবায় নমঃ ছিলিম ছিলিম কল্কে। তবে জ্ঞান ভাণ্ডার সে -এসব নিয়ে আলোচনা-ভালোচনা কবিতা পাঠ এখানে সিদ্ধ। নিষিদ্ধ শব্দটাই এখানে বিলুপ্ত।

তেঠ্যাঙ্গা কবি, ছড়াকার, মড়ার সৎকারী, তরকারীর ব্যাপারী, সুদখোর, আড়কাঠি… সবাই স্বব্যস্ত সমস্ত জগত উদ্ধারে-। এবার নোবেল প্রাইজটা কার গলায় ঝোলা উচিত, যুদ্ধবাজ কিংবা খ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট কি সেটা পাবেন, তার সবই কাব্যময় -তার চুলের ছাট, তার নিয়ম নির্দেশনা এবং সহবত। মহব্বত আলী যাদের নিষিদ্ধ করেন তাদের ঠাঁই নেই কোথাও, তবে কথা আছে ইলেকশনের পর আবারও কিয়ৎকাল লাল দালানের মোটা রুটি ডাল আর পায়রাবীর সর্দার হয়ে জঙ্গমে ঢুকবেন। দু একবার বেণীগরাদের ভাত না খেলে -‘বার বার কারাবরণকারী খেতাবটি জোটেনা, নেতা হতে, ভোটে দাঁড়াতে এসব বড্ড কাজের।

শহরের নিষিদ্ধ ঘিঞ্জি গলিতে লুকোচুরি খেলার মজাই আলাদা, পরের পকেট কেটে ওখানে দেদারসে রঙ্ তামাসা স্ফূর্তির একটা আলাদা মেজাজ, কেবল মাঝে মধ্যে গনেশ উল্টোনোর ভয়, তবে সেটাতেও একটা দুরন্ত মোহ, ঠোলারা (সব ঠোলারা নয়) টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়। সমাসন্ন শীতে আড় ভাঙার জন্য কেরু এন্ড কোং যথেষ্ট। ইষ্ট নাম জপ করে বোতল সাবাড় করে ভোরে থানায় অস্ত্রটা জমা দিয়ে ডেরায় ফিরে দে ঘুম। তাই দেখে হিসু করে ফেলেছে নগর কতোয়াল অলরেডি। কলরেডি মাইক সার্ভিস কবে উঠে গেছে কিন্তু মার্চের সাথে কলরেডি ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। -এইসব কথাবার্তা চলছে, চলবে ভোরের আজান অব্দি, তারপর এক লাইনের একটানা ঘুম।

এরপর প্রাতকৃত্ত সেরে স্নান সস্তার নাস্তা সেরে, কসাইয়ের মতো গোরুকে টেনে হিচড়ে স্লটারিংয়ে নেওয়ার মতো কবিতার তেলেসমাতি, গলায় গমক এনে ভুল তাল লয় স্কেলে কবিতা নামের ছাউনিপনা। তা সাতসমুদ্র তেরোনদীর জল ঘোলা করা, হুলো আর মেনির ঝগড়ার মতো করে কাব্যিকতা। কেউ আবার স্মরমে মরমে মরে বলে এবারের মতো ছেড়ে দাও আল্লা গড ভগবান ঈশ্বর। ব্যাখ্যা চলছে কাব্য কি, কত প্রকার, কে কে কতটুকু কবি বা অকবি এইসব। কারো আবার কবিতা কল্পের বাহারি আলোচনা, কবে স্বপ্নে প্রাপ্ত, কবে পেরথম প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাঁকা হ’য়ে, কেউবা -‘আমি তো এম্নি এম্নি..’। কেউ শুনছে, কেউ উদাস, কেউ তারই মধ্যে নাক ডাকছে..!

ইলেকশান নিয়েও কবিতা, ছড়া, কাশন, ভাষণ… হয়। সহনীয় নেতা আসছেন -অম্নি জয়ধ্বণী, রজনীগন্ধার মরা ডাটা ধরিয়ে একজনের কাছ থেকে উত্তরীয় চেয়ে নিয়ে (যেহেতু উত্তরীয় সব শেষ) তার গলায় পরিয়ে তোষামদির সুরে – ভাই, আপনি এসেছেন, এ আসর আজ ধন্য হ’লো, তাকে অমায়িকভাবে একজনের বলার মধ্যিখানে তাকে থামিয়ে মাইক দেয়া হলো, তিনি গদগদ চিত্তে বললেন তিনি নির্বাচিত হ’লে.. আপনাদের সব আব্দার পূর্ণ করে দেবো মাইরি। -হাত তালি, অথচ বছর চারেক আগেও তার পাতলুন -পশ্চাতে তালি মারা থাকতো, এবার নিশ্চিত জিতলে একশোটা গোরু মেরে খাওয়াবেন, আর অন্যদের জন্য রামপাঁঠা -কড়াল করে গেলেন।

তাকে গাড়িতে চড়িয়ে দিয়ে ফিরে আসলেন হট্টমেলার আধিকারীরা। ততক্ষণে গোস্মা করে ডায়াস ছেড়ে নেমে গেছেন যিনি বলছিলেন, তাকে অনুরোধেও ঢেকি গেলানো গেলোনা। এবার আর একজন রায়বাহাদুর উঠলেন তার কবিতা কবচাতে। তখন যিনি বিশেষ সুন্দরী, তিনি জানালেন তার এখনই বাস ধরতে হবে, তার শহরে তার অনেক কাজ পড়ে আছে, না গেলেই নয়, অনেকের তার এই হঠাৎ যাওয়া শুনে মুখ কালো হয়ে গেলো, মানে বদনখানি পুরোনো বদনার মতো মলিন হ’লো, কেউ কেউ ভেবেছিলেন রাত্তীরে কথার মলন মলবেন। -তা হলো না, অনুষ্ঠান পানসে জলো হয়ে গেলো, মন কারো কারো উচাটন। মহিলারা হিংসায় জ্বলছেন, কেনো তারা কি মহিলা নন, তারা কি পারেন না।

দামড়াদের কেউ কেউ বললো -বাড়িতে অনেক কাজ ফেলে এসেছি, আমাকেও যেতেই হচ্ছে, ছুৎ খুঁজে তিনিও বিদায় নিলেন। দুপুরে, মানে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় হলো, যারা তখনও কবিতা পড়েননি তাদের আস্বস্ত করা হ’লো বিকেল থেকে যতো রাত্রিই হোক আপনারা সুযোগ পাবেন। আসুন যৎ-সামান্ন আয়োজন দয়া করে গিলে ভাতঘুম সেরে আমরা আবার উপস্থিৎ হবো।
বিকেল হতে হতে সন্ধ্যা। কেউ কেউ এলেন, কেউবা ঘুরতে বেরিয়েছেন শহর পরিভ্রমণে, অডিয়েন্স বলতে গেলে ফাঁকা। তারই মধ্যে নাম ডাকা হ’চ্ছে -প্রায়ই নেই, যারা আছেন তারা একাধিক পদ্য ছড়া আউড়িয়ে সুখের ঢেকুর তুলে নামছেন। যেনো পাবালো নেরুদা, ফুকো, রবীন্দ্রনাথ…! বাবা গনশা কারো কপালে চন্দন সিঁদুর ছোওয়াচ্ছেন না, নিজেকে নিজেই ভক্তি প্রণাম সেরে, হেদল কুতকুত কাতুকুতু আর বিরক্তি দিয়ে নামছেন।

এরমধ্যে সহসা শহরে মাইকিং -‘আসন্ন নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা বাজায় রাখার প্রয়োজনে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের নির্দেশক্রমে সবধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সভা সমাবেস আপাতত নিষিদ্ধ করা হ’লো’। আয়োজনকারীদের মাথায় হাত, অতিথী অভ্যাগতদের বলা হ’লো আমরা দুঃখিত, লজ্জিত, ক্ষমা পার্থী। এবার আমরা শেষ করতে পারলাম না। নিশ্চয়ই সানন্দে সামনের বার আপনাদের পদধুলি আমরা পাবো। এবার এই সন্ধ্যারাত্রিতেই সবাইকে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে বিদায় নিতে হলো ! প্যান্ডেল খা খা করছে, ডেকোরেটরের লোকেরা সব ভেঙে নিচ্ছে, সরিয়ে নিচ্ছে, এক এক ক’রে ঝলমলে আলো গুলো নিভে যাচ্ছে।

ওখানে একজন ত্যাঁদোড় নারদমুনি ফোঁড়ন কেটে বললেন, আসলে কপাল -ওই সুন্দরী মহিলার চলে যাওয়ার সাথে এর যোগ আছে। লক্ষী বিদায় নিলে, সবই অলুক্ষণে হয়ে যায়, হ’লোও তাই। পাশে দাঁড়ানো আয়োজকদের একজনের মাথায় যেন কড়াইয়ের মাছ-ভাজা গরম-তেল পড়লো, তিনি চেঁচিয়ে বলে বসলেন -আপনার মতো আবাল কবির আর্বিভাবেই এবারের অনুষ্ঠানের এই দশা। এদিকে দশমাথার মোড়ে তখন প্রবল চাপ চায়ের দোকানে। ডিপ্রেশান ধেয়ে আসছে, আকাশে কালো মেঘ। নিশ্চই ইলেকশনের পর সব মেঘ কেটে যাবে। এর মধ্যে যারা হিংশুক তারা কোমায় চলে যাবেন বা অক্কা পাবেন। সবই জন-গণ-মন নর-নারায়নের ইচ্ছে।