নিঃশব্দ কান্না

আপডেট: জানুয়ারি ৫, ২০২৪, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

রেবেকা আসাদ

জামেলা উঠোনে বসে চুলোয় জ্বাল দেয়। গনগনে আগুনের আলো মুখে পড়ে। গড় গড় করে ভাত ফুটছে হাঁড়িতে। কত কথা বুকের ভেতর কষ্টের দলা হয়ে আছে। কারো কাছে বলতে পারেনা। হায়! দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে। একদিন তার কথা শুনতো যারা আজ তারা মুখ ফিরিয়ে থাকে। তার ছায়া পাড়ালেও যেন পাপ হবে এমন ভাব। জামেলা চুলো থেকে হাঁড়ি নামিয়ে চুলোয় পানি ছিটিয়ে ঢেকে দেয়। হাঁড়িটা ঘরে নিয়ে রেখে বারান্দায় বসে। আজ কাজে যায়নি। মনটা খুব খারাপ লাগছে। দুচোখ বাষ্পাকুল। একদিন তার সব ছিলো ৷ স্বামী, সন্তান, দেওর, ননদ, আত্মীয়-স্বজন৷ এখন কেউ নেই পাশে ৷ হায়রে যুদ্ধ ! কেড়ে নিয়েছে সব। আশে পাশে কোথাও জোরে শব্দ হলো, জামেলার বুকটা ধক করে ওঠে। যুদ্ধের দামামা যেন বুকের শিরা উপশিরায় সার চালায়। এক কালা হয়েছে তার। কোন শব্দ যে সহ্য করতে পারেনা। স্বামী আলান মেয়ে রসেছার সুখ কেবলি ভাসছে চোখে দ্বিরোত নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আলান জমি নিজের পাঁচ বিঘে জমিতে সে নিজে আবাদ করতো। মা ফাল হতো তাদের চলে ডে খুব উচ্ছ্বল প্রকৃতির মানুষ আলাল বিক্রি করে বাড়ি আসার সময় জামেলা আর রামছার জন্য কিছু না কিছু কিনে আনতো। জামেলার রং ফর্সা ছিল তখন। তার জন্য হলুদ না হয় লাল কাপড় কিনতো। জামেলা বলেছিল হ্যাঁগো, তুমি শুধু লাল আর হলুদ রুমের কাপড় কেন কেন? আর কোন রং কি বাজারে পাওয়া যায়না? হা হা হা.. করে হেসে উঠতো রসেছার কাপ। দূর পাগাল থাকবে না কেন। আসলে তোর গায় এই ফর্সা বেশি ফোটে তাই আনি। কেন কালো রঙের শাড়িওতো পাওয়া যায়। নারে- কালো মানে আঁধার। আমি আঁধার ভালো বাসিনে। তুই থাকবি আলোয়, বুঝলি ? জামেলার থুতনিতে নেড়ে কথাগুলো বলে আলাল। মানুষটা ছিল অন্য রকম মনের। দেশের জন্য তার দূরা ছিল। ছাব্বিশে মার্চ মখন দেশে আর্মি নামে, তখন রমেছার বাপের সেকি আস্ফালন। সারা বঙাল তখন বন্দি শিবির হয়ে গেল যেন। খোলাডাঙায় জামেলার শ্বশুর বাড়ি।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্রিম-দ্রিম শব্দ চারদিক কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ধান কাটা সারা হয়ে গেছে। মাঠে লাঙল
দিচ্ছিল আনিল। দূরে দুজনকে ধরাধরি করে নিয়ে যেতে দেখে হকি দেয়া কারে নিয়ে যাচ্ছো তোমরা হয়ছে? সাবের সুধার দুই পোলারে আর্মিরা গুলি করে ম্যারে ফেলায়ছে। হায় আল্লাহ! জমিতি লাঙল দিতি আমার সুমায় পোলের ধারে দেখা? হলো। কলো শঙ্করপুরি নানারে দেখাত যাচ্ছে। আর প্যারে ফেললো। ই.পি.আরগের সাথে যুদ্ধ হচ্ছিল, তালি কি কি তারা হ্যারে গেলো! ভাবতে ভাবতে করে বাড়ি আসে আলাল। লাঙল চষা বন্ধু আস্তে আস্তে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাসছে দামাল ছেলেদের বুঝে। আলাল ও বাদ যায়না। একদিন রাত সামেলা কে বলে- শোন, ঘরে চাউল, ডাউল মজুদ করে রাখলাম আব্বা-মা সবাই তোর পাশে থাকলো। আমি মুক্তিযুদ্ধে চললাম কবির, বাবলু, মামুন, তুহিন ওপের সাথে। আমাগের দেশ থেকে পাক আমি খেদায়ে তবে ফিরবো। সাধকানে থাকিস। রমেছার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় সে।

দিন কাটে জামেলার, মানুষটার কথা ভেবে ভেবে। বুকের মধ্যি আকুপাকু করে। বিয়ের পর থেকে কোনদিন তাকে ছাড়া থাকেনি। বাপের বাড়ি গেছে তাও সাথে করে নিয়ে গেছে। নামাজ পড়ে আর কাঁদে আল্লাহ মানুষটারে ভালো রেখ। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, দেওর মা সবাই জামেলাকে সান্ত্বনা দেয়। গভীর রাত চারদিকে নিস্তব্ধ। থেকে থেকে শিয়াল দূরে ডাকে। বাড়ির উঠোনে কি যেন খটাস শব্দ হয়। ঘুম ভাঙে জামেলার। কান খাড়া করে বাইরে কি হচ্ছে শোনার চেষ্টা করে। ঘরের কড়া নড়ে ওঠে, মুনসির গলা ও আজাদ দাদা মনে হচ্ছে, শোনার পাড়ার দবির কিডা? দরজা খোল। এত রাতে কিডা? আরে বাইরি বেরোও। আমি ইডা? তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। বাইরে বেরোয় জামেলার শ্বশুর। এবার জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে, ওই তুমহারা লাতকা কাঁহা গিয়া, কি বাতাও। আমি কতি পারবোনা কনে গেছে। মুক্তি হুয়া? আমি জানিনে কনে গেছে ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়। ঠা- ঠা-ঠান গুলরি শব্দ। ওরে আল্লারে শ্বাশুড়ির কান্নার রোল উঠে। সব ঘর সার্চ করো। কথা শুনে ভয়ে বুক কুঁঁকড়ে যায় জামেলার।

দড়াম দড়াম করে সব ঘরের দরজায় বাড়ি মারে। শূন্য ঘর সব। দুদিন আগে জামেলার মা আর দেওর বেড়াতে গেছে। জামেলার ঘরে বাড়ি মারে। জামেলা দরজার পিছনে, রমেছার চোখের আড়াল থেকে ছুটে পিছনে লুকায়। তবু শেষ রক্ষা হয় না। ঘরে ঢুকে সামনে রমেছাকে গুলি করে মারে। জামেল আসে, ওরে রয়েছারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে, দেখে অনেকগুলো মেয়ের মাটিতে লুটিয়ে আছে, সবাই কেমন অসাড়, কেমন বন্দি। তারপর দীর্ঘ নয় মাসের যে যন্ত্রণা প্রতি রাত প্রতিদিন হায়েনার কামনার রসদ ছিল তারা। জানোয়ার। একদলা থুথু ফেলে হানাদারদের উদ্দেশ্যে। মরতে চেয়েছে পারেনি। এক খণ্ড কাপড়ও ছিলনা কারো পরনে ওই চীৎকার করে ওঠে। মুক্তির আলো ফোটে জামেলাদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। কতগুলো দেবদূত এসে, যেন নিজেদের গায়ের চাদরে ঢেকে দেয় তাদের লজ্জা। সোনালী আলোর ঝলকানিতে চোখ মেলতে পারেনা জামেলা। আস্তে আস্তে আলো সরে আসে। বন্দি শিবির থেকে বেরিয়ে খোলাভাঙায় মায় ঠাঁই! হয়না। ঘৃর্ণায় দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। দ্’ুমাইল নদী ডিঙিয়ে শঙ্করপুরে গিয়েছিল জামেলা। সেখানেও তার ঠাঁই হয়নি। তার ভাই মেরাজ বলে, বুনডি বুঝিসতো ছল ম্যায়ে নিয়ে সংস্কারা করি। তুই আর বাড়ি আসিসনে। এই শুনে কাতরে ওঠে হৃদয় বেদনায়। দলা দলা ব্যথা বুকের বন্দরে চাপা দেয়। ফিরে আসে জামেলা। কি করবে- কোথায় যাবে-কি খাবে দিশেহারা সে। মনের সাহস জোগায় দাদির কাছে শোনা গল্প মনে পড়ে।

ভাবছো মিছে বলবে কিসে?/ যার ভাবনা ভাবছেন তিনি। ভাবো মন একবার তাকে। সাহস পায় মনে। রাজ মিস্ত্রির জোগালের কাজ করে এখন পেটের খিদে মেটায়। দেখতে দেখতে তেতাল্লিশ বছর হয়ে গেছে। রমেছার বাপ ফেরেনি আর। শ্বশুর বাড়ির বাগানের স্যারে এক কুঁড়ে ঘরে এতটা বছর কেটে গেল। নিজের ঘর টুকুও পায়নি মিরে, দেবরের দখলে এখন। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মোছে জামেলা।
ভাবী ও ভাবী বাড়ি চলো। হকচকিয়ে তাকায় মাকে লো। আজ ভোকাল্লিশ বছর পর দেওর কবির তাকে ভাশছে ভাবী বলে। যে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও কোনদিন কথা বলেনি। ও ভাবী বাড়ি চলো। ক্যান একদিন পর আমারে ডাকতি আসছো। তোমার নামে চিঠি আসছে। তোমারে সোনার করে বীরাঙ্গনাগের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেছে সরকার। এখন থেকে ভাতা পাবা। আর কামলার কাম করতি হবেনা তুমারে। কবিরের কথাগুলো কিছুই বোঝেনা, স্রোত উথাল-পাথাল ঢেউ ঢোলে। তার পাষাণ আর থাকবেনা, তালি রমেছা আর তার বাপ! আছ তেচাল্লিশ বছর পিছে। চুয়াল্লিশ বছরে পড়লো। এক বছর ধরে বাপের জন্যি ভেবে শোষছে। তাগের কষ্ট কি এরে মারে। বুকির মধ্যি থেকে। মনে মনে কথাগুলো আওড়ায় জামেলা হায় স্বাধীনতা হায়রে জীবন! এতদিন পর সেটার জন্য আপনজনরা ডাকিছে। অভাবে তাদের কাছে কতকিছুই না শুনতে হয়েছে তাকে। মুখ ঢেকে এবার জামেলা দূরে সরিষা ক্ষেতের দিকে তাকায়। হলুদ রঙে ছেয়ে আছে মাঠ সরষে ফুলে ফুলে। দিগন্তে যেন সে হলুদে মিশে একাকার।