বায়োস্কোপ

আপডেট: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

তাহমিনা শিল্পী

পৌষের সকালে নরম রোদ আমার মুখে এসে পড়ল। চোখ খুলেই সামনের দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সকাল নয়টা বেজে গেছে! ইস্ ঘুম ভাঙতে এত দেরি হয়ে গেল! আজকাল আর ঘুম ভাঙার জন্য আমাকে এলার্ম দিতে হয়না। রোজ ভোর বেলায় চায়ের কাপে চামচ নেড়ে মজিদ চাচার চা বানানোর টুঙটুঙ মিষ্টি শব্দেই সকালটা শুরু হয় আমার। মজিদ চাচা একজন অসাধারণ মান্ষু। তার সাথে আমার আলাপ অনেকটা নাটকীয়। প্রায় বছরখানেক আগে আমাদের মহল্লার রাস্তার পাশে একটি নতুন বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান উঠল। বাসার সাথে লাগোয়া ছোট্ট চায়ের দোকানটা মজিদ চাচার। সবগুলো চায়ের দোকানের নামগুলো ‘জলিলের চা দোকান’, ‘রশিদ টি স্টল’ এভাবে করে দোকানীর নিজের নামে।

কিন্তু মজিদ চাচার দোকানের নাম ‘বায়োস্কোপ’। আমার ভীষণ কৌতূহল হল কারণটা জানার। কিন্তু আমার বাবার ধারণা মহল্লার চা দোকানে মেয়েদের যাওয়াটা ঠিক ভালো দেখায় না। তাই আমার আর জানা হয়ে উঠেনা। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় দোতরার শব্দ কানে এলো। বারান্দায় গিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমি চমকে উঠলাম। মজিদ চাচা দোকানে বসে দোতরা বাজিয়ে গান গাইছে। আর কিছু লোক দোকানের বাইরে বেঞ্চে বসে চা খেতে খেতে গান শুনছে। অদ্ভুত এক দ্যুতি যেন ছড়িয়ে আছে তার চোখে মুখে। এবার আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না। পরদিন সকালে কলেজে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেলাম মজিদ চাচার দোকানে। তার দোকানের নামটা বায়োস্কোপ কেন চাইতেই সে বলল- ‘দোঁলন আম্মা কেমন আছেন? আপনার লেখাপড়া কেমন চলছে? যদি অসুবিধা না হয়, তাহলে ১কাপ চা দেয়।’

মজিদ চাচার মুখে নিজের নাম শুনে এবার আরেকবার আমার চমকানোর পালা। আমি বাবার নিষেধ ভুলে বসলাম দোকানের বেঞ্চে। বললাম, আপনি আমাকে চিনেন? আমার নাম জানলেন কি করে? কিছু না বলে শুধু একটু হাসলেন। খুব যত্ন করে চা বানিয়ে খাওয়ালেন। টাকা বের করে দিতেই এবার মুখ খুললেন। বললেন, ‘আম্মা আপনার কাছ থেকে আমি চায়ের দাম নিতে পারবো না। আমার একটা মেয়ে ছিল। আপনার নামেই তার নাম ছিল। এখন তার মেয়েটি কোথায় জানতে চাইলাম। মজিদ চাচা বলল-‘আম্মা অনেক লম্বা ইতিহাস। আজ সব বললে তো আপনার কলেজে যাওয়ার দেরি হয়ে যাবে।’ তারপর থেকে রোজ সকালে কলেজে যাওয়ার আগে মজিদ চাচার হাতের এককাপ চা আমার পাওনা হয়ে গেল। সেই সাথে তার জীবনের গল্প শোনা।

মজিদ চাচার পৈত্রিক বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর গ্রামে। চাচি আর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে দোলনকে নিয়ে ছিল তার তিনজনের ছোট সংসার। পেশা ছিল সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাবা-দাদার আদি ব্যবসা কাঠের তৈরি বাক্সে বায়োস্কোপ দেখানো। আর সন্ধ্যাটা কাটাতেন সখের দোতরা আর গানের সাথে। অনেক বড় বাড়ি ছিল তাদের। সবাই মজিদ চাচার গান শোনার জন্য জড়ো হতো তার বাড়ির উঠোনে। এভাবে হাসি-আনন্দে কাটছিল তার দিন।

সময়টা ছিল উনিশ’শ একাত্তার’মার্চ মাস। দেশটা তখন পাক বাহিনীর দখলে। হানাদারের কালো থাবায় চারিদিকে জ্বলছিল আগুন, ঘরে ঘরে মারা হচ্ছিল নিরাপরাধ হাজারো মানুষ। লাঞ্ছিত করা হচ্ছিল অসহায় মা-বোনদেরকে। তখন অনেকেই দেশকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল। যোগ দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনীতে। দেশের এমন দুর্দিনে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারেনি মজিদ চাচা। সেও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। আর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল তার পৈত্রিক বায়োস্কোপটি।

বায়োস্কোপের বাক্সটির মধ্যে করে সে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ পৌঁছে দিতে। সাথে খাবার ও খবরা খবরও পৌঁছাত। তারপর একদিন এলো সেই কালো রাত। পাকিস্তানিদের দোশর রাজাকারদের মাধ্যমে পাক বাহিনীর কাছে মজিদ চাচার মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করার খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল। সেদিন রাত তখনও মজিদ চাচা বাড়ি ফিরেনি। তার বাড়িতে হামলা করল পাক হানাদারেরা। তাকে না পেয়ে বাড়িতে চালালো তান্ডব। মেয়ে দোঁলনকে ধরে নিয়ে গেল ক্যাম্পে। বাঁধা দেয়ায় চাচিকে গুলি করে মেরে রেখে চলে গেল। মজিদ চাচা যখন বাড়ি ফিরে এলো তখন আর কাউকেই পেল না।

এর কয়েকমাস পর ১৬ ডিসেম্বর’৭১ দেশ হানাদার মুক্ত হল। বাংলাদেশের আকাশে উঠল বিজয়ের নতুন সূর্য। সবাই বিজয় কেতন উড়িয়ে ফিরল বাড়ি। মজিদ চাচাও মেয়ে ফিরার আশায় বুক বাঁধল। একদিন সত্যিই ফিরে এলো দোঁলন। কিন্তু ততোদিনে তার ভিতর বাড়তে শুরু করেছে পাকিস্তানী সেনাদের এক মানব ভ্রুণ। মেয়েটি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। মজিদ চাচা তাকে সান্ত¦না দেয়, সাহস জোগায়। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে তাকে শুনতে হত নানারকমের কটু কথা, টিপ্পনী। সহ্য করতে না পেরে একদিন দোঁলন বেছে নিল আত্মহননের পথ।

সেই যে বাড়ি ছাড়া, গ্রাম ছাড়া হল মজিদ চাচা, আর ফিরল না। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়েছে। সরকারি ভাতা নিয়ে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু মজিদ চাচা তা করেননি। কারণ যে দেশের জন্য তিনি এতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যে দেশের কিছু অকৃতজ্ঞ কিছু লোকের জন্য তার মেয়ের সম্ভ্রমের অসম্মান হয়েছে।

আজ সর্বস্ব হারা হয়েছেন। সে দেশেই আজ কিছু অসাধু লোকের জয়জয়কার চলছে। তাই তার আর কিছুই চাওয়ার নেই এদেশের কাছে। শুধু স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে প্রাণের তাগিদেই স্মৃতিসৌধে না গিয়ে পারে না। সবকথা বলে মজিদ চাচার অন্তর থেকে বেরিয়ে এসেছিল অনেকদিনের চাপা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস। চোখের কোণা ভিজে উঠেছিল। আর আমার মনে জন্ম নিয়েছিল পিতৃসম ভালাবাসা আর শ্রদ্ধা।

মহান বিজয় দিবসে, মনে পড়ল ফুল নিয়ে মজিদ চাচা স্মৃতিসৌধে গিয়েছে। আমাদেরও আজ বন্ধুদের সাথে স্মৃতিসৌধে যাওয়ার কথা। দশটায় কলেজে থাকতে হবে। হাতে সময় মাত্র এক ঘণ্টা। চটজলদি তৈরি হয়ে বেরুতে হবে। পৌঁছাতে দেরি হলে বন্ধুরা সবাই খুব রেগে যাবে। তাড়তাড়ি করে বিছানা ছাড়লাম। জানালার পর্দা সরিয়ে একবার বাইরে তাকালাম। মজিদ চাচার দোকান আজ বন্ধ। পৌঁষের হিমেল বাতাসে দোকানের চালের ওপর মাথা উঁচু করে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা।