লাল ওড়না

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৪, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ

আব্দুল আলীম:আশা, আসাদুজ্জামানের একমাত্র কন্যা। বয়স সাত। কন্যাশিশুর সহজাত প্রবৃত্তিতে ওর বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই চুরি, ক্লিপ, টিপ, আলতা,লাল ওড়না, লিপস্টিক দেওয়া ও শিখে যায়। কখন, কিভাবে, কার কাছে শিখে বলা মুসকিল, এর জন্য কোন টিউশন মাস্টারের দরকার পড়েনি। আশা, বাবা-ম’র একমাত্র আদুরে ধন, ও-ই যে নিরাশার অতলে ডুববে কে জানতো! তবু আশারা আশায়-আশায় রাত-দিন সাথে লড়াই করেই যেন জানান দিচ্ছে আমি আশা, আমার আশা কোন দিন হারিয়ে যাবেনা। শত সহম্র বছর ধরে জন্ম হবে,লাল ওড়না লক্ষ লক্ষ আশা। আশা একদিন হারিয়ে যাবে। আর আশা-নিরাশার গল্পগুলো লোক মুখে রয়ে যাবে। একবুক স্বপ্ন নিয়ে আসাদুজ্জামান মেয়ের নাম রেখেছিলো ‘আশা’। নওগাঁর মধুপুর গ্রামে সাত বৎসর আগে মায়ের কোল আলো করে জন্মেছিল ফুটফুটে আশা।

সে গ্রামীণ প্রকৃতিতে অন্য আর দশটা শিশুর মতই বেড়ে উঠছিলো। আশার জন্মের বছরই বাড়ির গাভিটা এঁড়ে বাছুর প্রসব করে। বাছুরটা ঘণ্টার খানিকের মধ্যে উঠে খুব লাফালাফি করছিলো। এখন ওর বয়স হয়েছে। তবে ওর মা-গাভিটা যে দুধ দিতো তার অর্ধেকটাই চলে যেতো আশার পেটে। বাড়ির উঠানে যে ডালিম গাছটা, লাল ওড়না সেটা আশার জন্মের বছরই লাগানো। গাছটা এখন ফুল-ফলের রঙে উৎকীর্ণ। প্রতি বছর অনেক ডালিম ধরে। বাড়ির হাঁস মুরগিগুলো আশার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে, আশার কণ্ঠ পেলেই তারা আশাকে খুঁজতে শুরু করে। আশা নিজের হাতে খাবার না দেওয়া পর্যন্ত তারা থামতে চাই না। যখনই আশা খাবার দেয় তখনই তারা নিশ্চুপ থাকে।

আশা দিনে-দিনে বেড়ে উঠছে, স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে, লিখাপড়ায় ভালো। সহপাঠিদের সাথে স্কুলে যায়-আসে, বিকালে তাদের সাথে খেলে, আবার ঘরকন্নার কাজেও সাহার্য করে। সে গেল মাসে নানার বাড়ি বেড়াতে গেল কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই বাবা তাকে নিয়ে এলো। মেয়েকে রেখে বাবাও একা একা থাকতে পারে না কি আশাকে আসতেই হলো। বাবার বুকের মাথা রেখে ও ঘুম পাড়ে, বাবার সান্নিধ্য ছাড়া ওর ঘুম আসে না। গেল শীতের শেষে বাবার সাথে বাড়ির পার্শ্বে একটা মেলায় যায় আশা। পছন্দের মিষ্টি, খেনলা কিনে। পরে অবশ্য মা’র বকুনি খেতে হয়েছে অনেক। বাবা বললো, লাল ওড়না মেয়ের সখ অপূর্ণ রাখতে হয় না, কেননা তারা পরের সংসারে চলে যাবে। সেখানে তার সখ পূরণ নাও হতে পারে। তাই বাবা হিসেবে একটু করেছি আর কি। স্রষ্টার নিপূণ হাতে তৈরি মানুষ।

বাড়ির কাছে বকুল গাছটাই ফুল এসছে, আশা প্রতিদিন সকালে লাল ওড়না সে ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে বাবাকে দেয়, বাবাও খুব আনন্দ পায়। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভাত খায় তারপর স্কুলে রেখে আসে। যতো দিন যায় আশা ততোই বড়ে হতে থাকে। পাড়ার মানুষগুলো তাকে খুব ভালোবাসে। অজান্তেই সবার মনে সে জায়গা করে নিয়েছে। গেল মৌসুমে আশার জ্বর হলো, অনেক ঔষধ পথ্য দিয়ে শেষে সাতদিন পর জ্বর ছাড়লে, ঘুম-ঘোরে আশা বাবা-মা’র কাছে সে লাল ওড়না চেয়েছিল। ও সুস্থ হয়ে গেলে পরিবারের সবাই ওর ওড়নার কথা ভুলে যায়। কিন্তু আশা তার বায়না ভুলে না। ও হর হামেশায় ওড়নার কথা বাবাকে মনে করিয়ে দেয়। ওড়নার কিইবা প্রয়োজন আছে তার? তবুও নাছোড় বান্দা সে। বাবা আশার কথা শুনে আর হাসে। বলে, -ঠিক আছে মা, আসছে ইদে ওড়না কিনে দিবো। আশা এবার তার বায়না থামায়। এভাবে দিন, মাস, সময় চলে যায় কিন্তু একটা ওড়না আর কেনা হয় না, বাবা ভাবে ওড়নার আর কি দরকার, এতোটুকু মেয়ে।

ওর তো ওড়না পরার বয়সই হয়নি। তাই ব্যাপারটাকে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। ইদ আশার আগে আশা লাল ওড়নার বায়না জুড়ে দেয়। অনেক কেনাকাটার ভিড়ে আসাদুজ্জামান ওড়না কেনার কথা ভুলে যায়। আশা, তার পছন্দের জিনিস পায়নি তাই তার মন ভার। বাবা তাই মেয়েকে সান্ত¦না সান্ত¦না দেয়, -মাগো মা, আর গোস্সা হয়েন না, আমি ওড়না কিনতে ভুলে গেছি, এখন অনেক রাত, ভোরে নামাজ সেরেই। তোমাকে ওড়না কিনে দিবো। শিশুমন মানতে চায় না তবুও বাবার কথা আশা অমান্য করতে পারে না, কেননা বাবা তাকে অনেক আদর করে। বাবার কথা আশার মাথায় ধরলো আর কোন মন খারাপ করলো না। মন খারাপ যত হয়েছে আশার, তার চাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছে বাবা।

তাই তো ইদের পরে আর দেরি না লাল ওড়না একটা কিনে দিতেই হবে মেয়েকে, মেয়ের আশা ভঙ্গ করা যাবে না। তাইতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্ত্রীকে বললো, মেয়েকে সাজিয়ে দাও ওকে বাজারে নিয়ে, ওড়না কিনে দিবো। যথারীতি বাজারে যাওয়া হলো, এ দোকান ওদোকান খুঁজে লাল ওড়না কেনা হলো। বাবার সাথে বাজার করার কি যে আনন্দ ! বাবার সাথে হাত ধরে ঘুরতে খুব ভালো লাগছে, তার মন চাইছে সারাদিন এমনভাবে শুধু ঘুরে বেড়াই। ঘোরাঘুরির মাঝে কিছু মিষ্টিও কেনা হলো। এক সময় বাবা, আশাকে বললো, এবার বাড়ি যাওয়া যাক না-কিরে মা।
মেয়ে বলল, -ঠিক আছে, আম্মা আমাদের জন্য চিন্তা করছে তাই না বাবা? সত্যিই তো এতাক্ষণ মায়ের কথা ভুলেই ছিলো, এখন মায়ের কথা মনে পড়েছে।

সন্তান সন্তানই, একটা সন্তানের মুখ দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কতোজন। দরগা, মাজার, খানকা, হুজরাখানাসহ বিভিন্ন উপাসনালয়ে মানত করে অনেকে, একটা সন্তানের আশায়। তারপরও কাক্সিক্ষত মুখের দেখা পায় না। যে ওড়নাটা আজ কেনা হলো আশার জন্য সেটা ব্যাগে নেয়নি শরীরে পরে নিয়েছে আশা। অনেকদিন পর আশা যে তার আকাক্সক্ষার লাল ওড়না পেল আসলে তা ব্যাগে নেয়া যাবে না। নতুন ওড়না পরে আশাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, বাবা চোখ ভরে কয়েকবার দেখল, আসলেই সুন্দর লাগছে, খুব সুন্দর মানিয়েছে আশাকে। বাড়ি ফেরার সব বন্দোবস্তু শেষ, অটোভ্যানে চড়লো তারা, বাবার পাশেই বসেছে আশা অটোভ্যান চলছে বাতাসে আশার ওড়না উড়ছে, গাড়ি চলছে, রাস্তার দু’পাশ সবুজ মাঠ, রোদ-মেঘের লুকোচুরি খেলা। মাঠের সাথে আকাশ-মিতালী দারুণ ! রাস্তার দ্’ুপাশের গাছেরা হাওয়া বিলিয়ে দিচ্ছে তখনও দুপুর গড়াইনি। বাড়িতে নেমে, আশা মায়ের সাথে দুপুরে ভাত খাবে। মনে মনে এই আশা। নতুন ওড়না প্রথমে মাকে দেখাবে, পরে সহপাঠীদের। কত আশা বুকে, কত স্বপ্ন দোল খেলে যায় চোখের পাতায়।

একটানা বাতাস বইছে, এক মাথা গলায় পেচানো আরেক মাথা গুছিয়ে গুছিয়ে রাখছে কোলের নিচে, তবুও বাতাস মানছে না যেন কোনো বাধা-নিষেধ। এক সারি সাদা বক উড়ে যাচ্ছে, আশার উদাস মন বকগুলো দেখছে, বক উড়ে যায় সে দেখে, তার চোখ যতোদূর যায়, লাল ওড়না অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। তাকাতে তাকাতে কখন যে নিজ গ্রামের রাস্তা চলে এসেছে আশা বুঝতেই পারেনি। গাড়ি চলছে -চলছে বাতাসের ঝাপটা লেগে কখন যে ওড়নার একমাথা চাকার সাথে জড়িয়ে পড়েছে কেউ বুঝতে পারেনি। আশাকে টেনে আছড়ে ফেলেছে মাটিতে। গাড়ি থামাতে-থামাতে আরো একটু দেরি, ততক্ষণে আশার একটা চিৎকার -বাবা আমাকে বাঁচাও। গলায় ফাস লেগে লুটিয়ে পড়েছে আশা।