দিপুর অপূর্ণতা

আপডেট: জানুয়ারি ১২, ২০২৪, ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ

দুলাল আলম


সিগারেটের ধোয়া বাতাসে গোল্লার মতো উড়ে। জোরে ফু দেয়Ñ বাতাস সরে গিয়ে আবার ঘুর্ণি দিয়ে ফিরে আসে প্রান্তরে। সুন্দর আকৃতিতে নর্তকীর পায়ের নূপুরের ধ্বনি স্বপ্নীল আবহে মিশলে মনপ্রাণ শীতল হয়ে যায়। তৃতীয়বার চোখ পিটপিট করে স্বপ্নচারী মানুষের মতো আনন্দ জ্বালিয়ে সুবাস ছড়িয়ে, প্রাণের ঘরে খেলা করে। দিপু স্বপ্নাতীত হয়ে যায়। কে যেন আসছে ঘুঙুর পরে, শরীর দুলিয়ে। খুব কাছে এসে ললিতার চোখে তাকায় আবার ঝটকা ঘুর্ণিতে ফিরে যায় রাত-দিন। পাওয়া যায় না শূন্যতায়, ফেরে চোখ দুলিয়ে। জানালার পাশে রঙ্গন গাছটা একা একা নাচেÑ কখনো পাতাগুলো দুলে উঠে। দূরের কুহুকুহু পাতার-বীণায় মর্মর সুর তোলে। সুন্দরের রূপ রৌশনে মিলে যায়। আবার নববধূর আলেয়াতে ফিরে আসে সে। নূপুর পরে ছান্দিক শব্দে ঝঙ্কারে দোল খায়। নড়ে চড়ে বসে দিপু।

গোধূলি ডানায় ভর করে একটা দিন চলে যায়। আর শুরু হয় সুন্দরের ধ্যান। রূপ ললনার ছন্দে মাতোয়ারা, বিখ্যাত হয়ে উঠারা তাতে নেতিয়ে পড়ে। দিপুর কাছে তা ভাল লাগে। খুব ছোট বেলার কথা মনে পড়ে তার। তারা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই নিপু ব্যাংকার্স। স্নেহের বোন অনামিকা আর সে। খুব আদর স্নেহে মানুষ করে দিপু বোনকে। ছোট বেলায় তাকে নিয়ে পদ্মার ধারের বৈশাখী মেলায় যেত দিপু। অনামিকা আবদার করত- ‘ভাইয়া আমাকে ঘোড়া কিনে দাও।’ দিপু ঘোড়া কিনে দিত। সাথে ব্যাঙ-গাড়ি আর লাল চশমা। অনামিকা যখন লাল চশমা পরত তখন তার দুনিয়াটা লাল মনে হতো। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করত- ‘ভাইয়া সবই কি লাল, আমি যে লাল দেখছি।’ -‘দেখবি তোকে একদিন লাল রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দেব।’

অনামিকা একটু লজ্জা পেত, আর লাজুক দৃষ্টিতে তাকাতো ভাইয়ের দিকে। তখন তার কাছে মনে হতো পৃথিবীটাই রঙিন। তখন দিপু মনে মনে হয়ে যেত কোন এক সুলতান। আর বোনকে জিজ্ঞেস করত, বাড়িতে মায়ের জন্যে কি নিয়ে যেতে হবে বল। ভাইয়া, হ্যাঁ, মায়ের জন্যে জিলাপি নিবে। আচ্ছা, তুই খাবি, মা খাবে, প্রয়োজনে নিপু ভাইও খাবে। মেলা থেকে বাড়িতে ফিরে এসে মায়ের কাছে বর্ণনা করত সবকিছু দিপু। মা তো ভারি খুশি হবে এটা পেলে। মা বলবে- লক্ষী ছেলে আমার। ছোট বোনের প্রতি কত খেয়াল রাখে।

দিপু আবার বলল, দেখতে হবে তো অনামিকা আমার বোন। মা নিশ্চিন্ত হতেন। যাকগে, তার বাপ মারা গেছে। কপালে লেখা ছিল মারা গেছে। তবুও রেখে গেছে একটি ভাল ছেলে, যে সবাইকে দেখে রাখে।

দিপুর মনে একটা আত্মতৃপ্তি আসে। এইতো বেঁচে থাকা। এই তো জীবন। সমুদ্রের উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মাঝে ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়ে ভেসে থাকাই নিপুণতা। নিজেকে টিকিয়ে রাখাই সুন্দরের আভিজাত্য। দিপুর নৌকা ভেসে থাকবে- যদি সে পরিচালনা করে শক্ত হাতে। দেখতে দেখতে একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি পেয়ে গেল নিপু। সে সবার বড়, পড়ালেখায় ভাল। নবম গ্রেডে চাকরি পেলে মা খুব খুশি হয়। তিনি ভাবেন, এবার মনে হয়- সংসারের দুঃখটা যাবে। অভাবের সংসার একটু সুখের মুখ দেখবে। কিছুদিন ভালই চলে কিন্তু বাধ সাধে, বিয়ে। নিপু ধনীর দুলালী সুইটিকে বিয়ে করে। সুইটি সব সময় মেকআপ, সাজগোজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। পার্টি, নাচ-গান তার নিত্য সঙ্গি। হোটেলে নাচেগানে হৈচৈ করে কাটায়। ওর খরচ যোগাতে নিপু হিমসিম খায়। তবুও প্রিয়তমা বউকে রুষ্ট করতে পারে না। প্রয়োজনীয় সব আবদার পুরণের সে সজাগ থাকে।

ঘরের বউ রাত করে বাড়ি ফিরে, এটা শাশুড়ি মায়ের পছন্দ করে না। বউ- শাশুড়ির ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। নিপু বউয়ের আবদার মেটাতে এক সময় মায়ের পরিবার হতে আলাদা হয়ে পড়ে। একটি পরিবার ভেঙে দুই পরিবারে পরিণত হয়। কোন পরিবার কারো খোঁজ রাখে না। অনামিকার দায়িত্ব পড়ে দিপুর উপর। সেই সাথে মায়ের দ্বায়িত্বও, সে সময় দিপু ছাত্র ছিল। দিপু, পরিবারের অভাব অনটনের সময় হাল ধরে সংসারের। পড়া চালিয়ে যেতে থাকে। চালিয়ে যেতে থাকে টিউশনি। সকাল বিকাল টিউশনি আর দুপুরে ক্লাস দিপুকে বড় ব্যাস্ত করে তোলে। তবুও মা বোনের দিকে তাকিয়ে সে সব সহ্য করে। সে তো এখন পরিশ্রম করা শিখেছে। ঘাম ঝরিয়ে ইনকাম করে পরে মায়ের আঁচল ভরা দোয়া, বোনের শ্রদ্ধা-ভালবাসা, তাকে উজ্জীবিত করে। মাঝে মাঝে সে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ে।

কি ভাবে চলবে জীবন। ঝরে পড়বে নাতো অকালে? কিভাবে বোনের বিয়ে দেবে? উজ্জ্বল চঞ্চল বোনটি অকালে ঝরে যাবে নাতো ? জীবন চলবে কিভাবে ? চিন্তান্বিত মনটা গভীর হতাশ হয়ে পড়ে। গভীর ভাবনার জগতে ঢুকে পড়ে সে। চলে যায় পুরোনো প্রেমিকা তৃণার কাছে। সময় চলে যায়, পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে তৃণার ডাক্তার বাবা কলেজে নিতে আসে মেয়েকে। সেখানে পরিচয় হয় তৃণার বাবার। ডাক্তার সাহেব জানতে চান দিপু তৃণার সাথে পড়ে কিনা। জবাবে দিপু জানায়, হ্যাঁ। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তৃণার বিয়ের জন্যে ডাক্তার ছেলে ঠিক হয়। একদিন শুভক্ষণে ডাক্তারের সাথে তৃণার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরে তৃণা বুঝতে পারে দিপু তাকে ভালোবাসে। কিন্তু চিন্তার মাত্রা বেড়ে যায়। এসব বিষয় নিয়ে দিপু চিন্তিত থাকে।

মরা ফুলের মতো ভেঙে পড়ে। তবু সে পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষাতে ভালোভাবে পাশ করে, তারপর ঢাকা ভার্সিটি কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হয়। নদীর জল সাগরে পড়ে। দিপু অনেক ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিজেকে নতুন ভাবে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। এক সময় সফল হয়। সংসারের চাকা ঘোরাতে গিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি দেবার সময় পায় না। আবার টিউশনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ইনকাম বাড়ার সাথে সাথে বাবা-মাকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসে ঢাকা শহরে। দিপুর জীবন গড়িয়ে গড়িয়ে আস্তে আস্তে চলতে থাকে। এক সময় গতানুগতিক হয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব থেকে দিপু আলাদা হয়ে পড়ে। সাথের ছেলেমেয়েরা সেকেন্ড বা থার্ড ইয়ারে সাথি বেছে নেয়। পড়ে থাকে হতভাগারা। অতিরিক্ত ভালরা নিজেকে শামুকের খোলসে আটকে রাখে, আত্মোন্নয়নের জন্যে। অনার্সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করে সে। বোনের বিয়ে দেবার জন্যে সে বেশি পরিশ্রম করতে থাকে। চিন্তায় চিন্তায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এক সময় তার মাথা গুলিয়ে যায়। পড়া মনে থাকে না। কি উদাসিনতায় ধরে, কে জানে।

মাস্টার্স পরীক্ষার সময় সে ফেল করে। দ্বিতীয়বার পাশ করে। বোনের বিয়ে দেবার জন্য সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ভাল ছেলের অভাবে সে বোনের বিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়। ওদিকে মায়ের অসুস্থতা বাড়তে থাকে।। ঔষধের টাকা জোগাতে দিপু হিমসিম খায়। কোন তাল খুঁজে পায় না সে। এক সময় বেকার হয়ে পড়ে সে। টিউশনি দিয়ে চলে না। জীবনের পথে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। এভাবে কয়েকটা বছর পার হয়। তারপর কলেজে রসায়নের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পায় সে। পরে মায়ের দেখাশোনা আর বোনের বিয়ে এর জন্য নিজের বিয়েটা আর হয়ে উঠে না। চাকরির সুবাদে মোটামোটিভাবে তার সংসার চলতে থাকে। কিন্তু সে তৃপ্ত হতে পারে না। সিগারেট ও পান খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু টিউশনিটা ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র শিক্ষকতার উপর নির্ভর করতে হয় তাকে।

কিন্তু জীবনের সমীকরণ মেলাতে সে ব্যর্থ হয়। মনের ভেতরে বিভিন্ন মাত্রার রি-অ্যাকশান চলতে থাকে। কোনকিছুতেই পাত্তা দেয়না সে। এভাবে সময় কাটতে থাকে। জীবন থেকে ছয়চল্লিশটি বছর পার হয়ে যায়। তারপর তার মা মারা যান। শোকে মুহ্য হয়ে পড়ে দিপু। বোনের বিয়ে না হওয়ার জন্য অন্তর বিষিয়ে উঠে তার। এক সময় বুকে ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। ডাক্তার বললেন বিভিন্ন টেস্টের কথা। তার তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। ডাক্তার তাকে হার্টে রিং পরানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু দিপু তাতে কর্ণপাত করে না। হৃদয়ে যার ব্যথা তার রিং দিয়ে সারবে কি করে।

কোনো কোনো অসুখ বয়ে বেড়াতে ভাল লাগে। সুন্দর অসুন্দর ভাব মনের ভেতর দোলা দেয়। সে ভীষণ একা হয়ে যায়। অপূর্ণতা জীবনকে ঢেকে ফেলে। এ সময়ে হয়ত দুনিয়ার সবকিছু দিলেও জীবন পূর্ণতা পাবেনা। দিপু হাল ছেড়ে দেয়। গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে সে। এক সময় বুকের ব্যথা বেড়ে যায়। তবুও পাত্তা দেয়না। ভাবে ব্যথার কাছে সে পরাজিত হবে না। সে ব্যথাকে পরাজিত করবে। সংগ্রামে মুখর হয়ে থাকে সে। শোভিত হয় চারিদিক। রাতের বেলা সমীকরণ মুখস্ত করে ইকুলিব্রিয়া করে সে। ঘুমাতে চেষ্টা করে। স্বপ্নে আসে, সে একটি ফুল বাগানে ঘুরছে। তার চারদিকে ডালিয়া, গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুটে আছে। সবাই যেন হা করে তাকিয়ে থাকে দিপুর দিকে। তুমি আমাকে নাও, কাছে নাও পাপড়িগুলো এভাবে মিনতি করে। খুব আস্তে একটি পাপড়ির গালে হাত দেয় দিপু। কী আশ্চর্য টুপ করে ঝরে পড়ে। ঘাসের উপর রাতের শিশির ছিল, তার সাথে ধাক্কা লেগে লেপ্টে যায়। তুমুল বিতর্কে দুজনে

এক হয়ে মা-মাটির বুকে আশ্রয় নেয়। একটা তীব্র সুগন্ধ ছুটে আসে। দক্ষিণা বাতাসে ভেসে এসে নাকে লাগে দিপুর। শেষ রাতের দিকে বুকের ব্যথাটা বাড়ে। একটা ট্যাবলেট খাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে না সে। শেষ দৃষ্টিতে দেখে অন্ধকারটা তার দিকে ছুটে আসছে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকে অনামিকা। মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয় দিপুকে। নিথর দেহ পড়ে থাকে তার। আর অশ্রুর বন্যায় ভেসে যায় অনামিকা।